বাবা

বাবা: একটা পরিবার, তা গড়ে ওঠে মা আর বাবাকে ঘিরে। একটা শিশু যখন এই পৃথিবীতে আসে, তখন কিন্তু শুধু একটি জন্মই হয় না। একইসাথে জন্ম হয় একজন মায়ের, একজন বাবার। শিশু নিজেই তাঁর জন্ম দেয়। আর কিছু কি জন্ম নেয়? দায়িত্ববোধ, মমতার সাগর, বাঁধভাঙা ভালবাসার জোয়ার আসে । মাকে বিশ্লেষণ করার চেস্টা করাটাই ধৃষ্টতা। আর বাবা? এই এশিয়ায় আমাদের শেখানো হয় নৈতিক মূল্যবোধ। আর তাঁর বড় অংশের চর্চা হয় বাবাকে ঘিরে। “বাবা” ডাকটি এক বিশাল বনস্পতির পদবী। যিনি সবসময় আগলে রাখেন তাঁর ভালোবাসার মানুষগুলোকে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পারফিউম কী? সারাদিনের কর্মক্লান্ত বাবার শার্টে লেগে থাকা ঘামের গন্ধটা। যেটা সাক্ষী, তাঁর কস্টের। নিজের সন্তানের মুখের লাবণ্য ধরে রাখতে তাঁর হাতের চর্মের রুক্ষতা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল অংশ। তাঁর পরিশ্রমের, সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলার কথা মনে পরলে কেন মনে হবে না কচি ঘাসের মত নরম? কে বলে বাবা রুক্ষ? কর্কশ? গম্ভীর? আমার কাছে সেই বাবা হলেন শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি।। যাকে দেখলেই মাথা নুয়ে আসে আপনাআপনি। এই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। তা তাঁর বয়স যতই হোক না কেন। বাবা হয়ে ওঠে সেরা বন্ধুও। সেই বাবার কাছেই শেখা হয় ভালবাসা, সম্পর্কের মর্যাদা। “জীবনের প্রথম সাইকেল চালানোটা আমার বাবার কাছেই শেখা”- এই কথা বলতেও কত গর্ব হয় সন্তানের। রিকশাচালক বাবাটা, যে পাঁচটা টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে, সে যেমন বাবা, এসিরুমে বসে আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট সামলানো প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকা মানুষটাও বাবা। সেই রিকশাচালক বাবাটা তাঁর ছেলে কিংবা মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে যখন ভর্তি করায় কোনো নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ফেলা বাবাটা সেদিন জিতে যায়। পাঁচ টাকার জন্য তাঁর করা বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান সেদিন জিতে যায়। বাবাদের ত্যাগ সেদিন জয় পায়। নিজের ব্যার্থ জীবন আর ব্যার্থ থাকে না। সেটাও সোনায় মোড়ানো ষোল আনার বিজয় হয়ে যায়।

বাবার মৃত্যু- আর সাথে সাথে ঘটে যায় অনেক অনেক না বলা স্বপ্নের অপমৃত্যু। ছুটে আসে হাজারটা বোঝা। এসে যায় দায়িত্ববোধ। আগেরদিন মায়ের হাতে ভায় খেয়ে কলেজ যাওয়া ছেলেটা বাজারের ব্যাগ হাতে যায় বাজার করতে। কোনোদিন লোকালে না চড়া মেয়েটা খুব সহজে ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে টিউশনিতে যায়। পারিবারিক উৎসবগুলোতে কারা যেন ফিসফাস করে। একটা মানুষ থাকতে পারতো আজ সেই উৎসবে, সে নেই। তাঁর শূন্যতা হাহাকার করে সেই উৎসবে। পরিবার আর পরিবার থাকে না। অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে পরে। যার সৈনিকে পরিণত হয় পিতার রেখে যাওয়া স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা।

জনহীন এক সমাজ কল্পনা করা কতটা কঠিন হতে পারে কারো জন্য?  ধূ ধূ প্রান্তর, রুক্ষতার ছায়া যেখানে, সে ছায়াও শীতলতা দেয় না, দেয় চরম দুঃখ। পাথরে পরিণত হয়ে যাওয়ার অনুভূতিই বা কেমন?  ঠিক তেমন নয় কী? বাবাকে ছাড়া একটি পরিবার?

বাবা মানুষটা বড্ড বেরসিক। সহজে হাসেন না। প্রাণ খুলে তাঁর সামনে হো হো করে ওঠা যায় না। কেমন যেন ভয় ভয় করে। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লাগে এই বুঝি ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করবেন, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?” শক্ত করে ধরে রাখা চোয়ালে ফোটে না কোনো অভিব্যাক্তি । এমনভাবে থাকা পিতার সাথে খুব একটা সহজে সন্তানের যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। অথচ তাও কত আত্মিক বন্ধন বাবা আর সন্তানের। মা আর বাবা- দুইজন কী আলাদা? নাহ। মা জন্ম দেয়, বাবা বাঁচিয়ে রাখে। অন্তত এখন অব্দি বেশিরভাগ পরিবারেই বাবাই হলেন খুঁটি। তাতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে সেই পরিবার। এই বাবাকে ভাল না বেসে কিভাবে থাকা যায়? অথচ আজো কত বাবা মায়ের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয় বৃদ্ধাশ্রমের বাতাস। একসময়ের প্রতাপশালী কিছু বটবৃক্ষ পরিণত হয় ঝোপে। কাটার  ঝোপ। পরম মমতার সন্তানের জন্য পরিণত হন তিনি কাটায়।  যাকে একসময় শ্রদ্ধায় চোখ তুলে দেখতে ভয় পেতো ছেলে-মেয়ে, তারাই আর বিরক্তিতে চোখ কুচকে তাকাতে ভয় পায় না। কেমন করে যেন অংক ভুল হয়ে যায় বাবার। কিছুতেই হিসেব মেলে না। মনে হয়, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।

বাবার সাথে যুক্ত হয়ে, নিজেকে বাবার শেষ বয়সের লাঠিতে পরিণত করবে সকল সন্তান- এই তো কাম্য। কতটা আনন্দময় হবে সেদিন? যখন পৃথিবীতে আর কোনো বৃদ্ধাশ্রমে অনাথ বাবারা থাকবে না। কেউ আর সন্তানের বিদেশ ফেরত হওয়ার অপেক্ষায় বৃথা দিন গুণবে না? না থাকবে কোনো করুণ চোখে জলজমা অসহায় বাবা। সেদিন জিতে যাবে পিতৃত্ব। জিতে যাবে সকল বাবারা।

 

বাংলাকোষে লিখুন, আয় করুন... [email protected] 
বিঃদ্রঃ বাংলাকোষ কোনো সংবাদপত্র নয়, এটি মূলত একটি আর্কাইভ। বাংলাকোষ এ প্রকাশিত সকল তথ্য কপিরাইট এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোনো পূর্বানুমতি ছাড়া বাংলাকোষের কোনো তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। তবে অব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রসহ ব্যবহার করতে পারবে।