মা শব্দটি হয়তো খুবই ছোট, কিন্তু এক বর্ণের এই শব্দের শক্তির তুলনা হয় কি? গর্ভে ধারণ করেন তিনি, তাঁর দেহ থেকে রক্ত, মাংসের এই দেহ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। মানুষের আকার লাভ করে, মানুষ হিসেবে পরিচয় লাভ করে। মাতৃত্ব যে শুধু একমাত্র মানুষের মধ্যেই আছে, তা কিন্তু নয়। ঘৃণ্য পশুটাও যখন মাতৃত্ব লাভ করে, তখন তারমধ্যে স্রষ্টার রহমত আছে ভেবে সকলে তাঁর প্রতি মায়া দেখায়। মাতৃত্ব হলো সর্বোচ্চ সম্মান, এমনকি অনেক সমাজব্যাস্থায় একজন নারীকে তখনই পূর্ণাঙ্গ ধরা হয়, যখন তিনি মা হন। সমাজ, সংসার, জাতি, সর্বপরি মানবসমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাতৃজাতির কাছে সমগ্র মানবকূল ঋণী। একান্তই অসহায় মা ছাড়া।
মা কে? তিনি গর্ভে সন্তানকে আশ্রয় দেন। মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে বড় হয় মাত্র একটি কোষ থেকে জীবনযাত্রা শুরু করা প্রাণীটি। মাতৃজঠরেই সেটি একটি মাংসদলা থেকে ভ্রূণ, ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। মায়ের অসীম কস্টের গর্ভযন্ত্রণার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘোটে গর্ভবাসের। জন্ম নেয় একটি প্রাণের। পৃথিবীতে এসে দাঁড়ায় নবজাতক। ঘোষণা করে তার এই পৃথিবীর মাটির ওপর অধিকার। এই অধিকার তাকে দিয়েছে তাঁর মা। সেই মাকে সর্বোচ্চ সম্মান না দিয়ে উপায় কী?
মেডিকেল সায়েন্সের কারণে এখন গর্ভস্থ শিশুর বেড়ে ওঠাসহ বিভিন্ন পর্যায় পর্যবেক্ষণ করা যায়। গর্ভধারণের কারণে মায়ের শরীরে অনেকরকম পরিবর্তন আসে। এইগুলোর কয়েকটা স্থায়ী, আর কিছু অস্থায়ী। সন্তান ধারণ করা মায়ের জরায়ুর বৃদ্ধির কারণে যত দিন যায়, তত শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর চাপ বাড়ে। শিশুর বৃদ্ধির সাথে সাথে ডায়াফ্রেমে চাপ পরে। ফলে মায়ের শ্বাস নিতে কস্ট হয়। মাঝেমাঝে দেখা যায় অস্থির লাগছে। এইসময় হরমোনাল সমস্যাও স্বাভাবিক। আবেগ প্রবণতা, ইচ্ছা –আকাঙ্খার পরিবর্ত ঘটে তাঁর শরীরে। মায়ের জন্য কস্টকর হয়ে পরে তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপ সামলে চলা। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয় সমস্যা, জোরে হাসলে, কাদলে বা এমনকিছু করলেই চাপ পরে ফুসফুসে, সেখান থেকে ডায়াফ্রামে, আর সেখান থেকে ব্লাডারে। লজ্জায় পরতে হয় তাকে, বলতেও পারেন না অনেকসময়। কিছুদিন পরপর ছুটে যাওয়া ডাক্তারের কাছে, একগাদা নিয়ম-বিধি মানার মত হাজারো কথা মেনে চলতে হয়, মাথায় রাখতে হয়। আর এসবই পালন করে চলেন এই মানুষটি, শুধুমাত্র অনাগত বাচ্চাটির সুরক্ষার জন্য। মাতৃজঠর থেকে নিরাপদ আশ্রয় আর কোথায়? যেখানে সন্তানের সমগ্র প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ হয় মায়ের শরীর থেকে। মা যেভাবে যত্ন নেবেন, তেমন করে নিজেও নিজের যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়।
গর্ভযন্ত্রণার সাথে তুলনা করা হয় আগুনে পুড়ে যাওয়ার সাথে, শরীরের কয়েকটি হাড় একসাথে ভেঙে যাওয়ার সাথে। এই কস্ট সহ্য করে সন্তানকে জন্ম দেয়ার পর পিতার সাথে সম্মিলিতভাবে বড় করে তোলেন তিনি। অনেক সন্তানের পিতা থাকে না সেইক্ষেত্রে মা একা সংগ্রাম করেই সন্তানকে বড় করেন। যোদ্ধা সেনাপতির মত সন্তানকে জীবনে চলার নির্দেশনা দেন। সন্তান বড় হয়, অনেকসময় যায় দূরে। পড়াশনার ফাঁকে রোজ রাতের খাবার থেকে শুরু করে এক কাপ চায়ে পর্যন্ত তার মন হাহাকার করে সেই মায়ের হাতের ছোঁয়ার জন্য। অগোছালো জীবনে তাঁর হাতের ছোয়া এনে দেয় পরম সৌন্দর্য। বালিশের কভার যত্ন করে পরিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে ভাত খেয়ে হাত মোছা পর্দাটায় পর্যন্ত থাকে মায়ের স্পর্শ। রোজ রাতে তাই ঘুমুতে যাওয়ার সময় প্রবাসী সন্তানের বুকে হাহাকার জেগে ওঠে মায়ের জন্য।
মা পুরানো যুগের, যন্ত্রপাতিগুলো বুঝে উঠতে পারেনা। বারেবারে হাতের বাটন ফোনে কল করার জন্যেও ডেকে বিব্রত করেন। বাইরের কেউ আসলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকেন, বন্ধুবান্ধবের জন্য কাড়ি কাড়ি খাবার তৈরি করে নিয়ে আসেন। আর শুধু নালিশ করেন ছেলের নামে। আরেকটু গোছানো,তাঁর আরেকটু ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে , সন্তানকে আরেকটু এগিয়ে যেতে দেখার জন্য তাঁর সেই হাহাকারেরই বা তুলনা আছে কি? রোজ সেই লজ্জাশীল, পরম মমতাময়ী মায়ের নামাজের সময় আল্লাহর দরবারে চাহিদা থাকে শুধু সেই সন্তানদেরই জন্যে। নিজের জন্য একটা জিনিস হয়তো চাইবেন না, কিন্তু সন্তানের জন্য চাইতে ভোলেন না। মা নিয়ে উক্তি
মা আর সন্তান, একে অন্যের পরিপূরক। সন্তান ছাড়া মা হয় না। জন্মদাত্রী মা-ই কি শুধু মা? নাহ, অন্যের জন্ম দেয়া সন্তানকে পালন করে পূর্ণ মাতৃরুপে পরিণত হয়েছেন- এমন গল্পও আছে অনেকের জীবনে। এইজন্য বলা হয়, মাতৃত্ব সবমেয়ের ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাকে শুধু জাগিয়ে তুলতে হয়। ভালবাসার জীয়ন কাঠিতে খুলে যায় মমতার দোর। জন্ম না দিয়েও একজন নারী পরিণত হন মায়ে।
মায়েরা কখনো সন্তানের জেনে-বুঝে কিংবা অজান্তে দেয়া কস্টকে কস্ট ভাবতে পারেন না। সেই ক্ষমতাই হয়তো নেই তাদের। কিন্তু মায়ের চোখের জলের রয়েছে সব ধ্বংস করে দেয়ার শক্তি। আল্লাহর দরবারে যার পদতলে জান্নাত ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁর চখ দিয়ে যেন কেবল আনন্দাশ্রু গড়ায়- এই দোয়া করি।