পদ্মা সেতু বা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প , বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এই কাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প যেন বহুদিনের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্যের দ্বার অবারিতভাবে উন্মোচিত করে দেয়া অলীক এক সৌভাগ্যসোপানের বাস্তব রূপ।
কংক্রিট আর ষ্টীলে নির্মিত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা সম্বলিত দ্বিতল এ সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিমেয়। ৩৮৪ ফুট গভীর মোট ৬ টি পাইলিং এক একটি পিলারের জন্য,এমন মোট ৪১ টি পিলারের উপর ভর দিয়ে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ভাবমূর্তি বদলে দেবার মূল চালিকাশক্তি পদ্মা সেতু নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেবে। উল্লেখ্য, সম্পূর্ণ সেতুতে মোট পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৬৪।
৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ কিলোমিটার প্রস্থের চার লেনের সড়কপথ ও দ্বিতীয় স্তরে একটি একক রেল সংযোগ সম্বলিত ৪১ স্প্যানের দ্বিতল দেশের সর্ববৃহৎ এ সেতু যেন রচনা করতে বসেছে সমৃদ্ধির দারুণ এক উপাখ্যান।
ধারণা করা হচ্ছে, সেতুটি নির্মিত হবার ফলে দেশের বার্ষিক জিডিপি শতকরা ১.২% হারে বেড়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ সরকার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘চায়না মেজর ব্রীজ’ এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এবং চায়না মেজর ব্রীজ কোম্পানি বাংলাদেশে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অধীনে তাদের কার্যক্রম শুরু করে ইংরেজী ২০১৪ সালের ৭ ই ডিসেম্বর, যে কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এবং সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী, এই প্রকল্পের খরচ ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৪০ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা। প্রকল্প পরিচালকের তথ্যমতে , প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কর্মক্ষম শ্রমিকের শ্রম ও উৎসর্গে নির্মিত এ সেতু।
শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়াকে যুক্ত করে পদ্মা সেতু এবং দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ১৪ কিলোমিটার এবং বিস্ময়করভাবে, দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের পাশ থেকে সুড়ঙ্গ করে নেয়া হয়েছে বাইপাস সড়ক।
এবং উল্লেখযোগ্যভাবে, নদীশাসিত অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দুই পাড়ের ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা।
উৎসর্গঃ পদ্মা সেতুর স্বপ্ন সার্থক করতে আত্মত্যাগে উদ্ভাসিত সকল শ্রমিক এবং করোণা ভাইরাসে আক্রান্ত সকল কর্মী যাদের অসামান্য ত্যাগে আলোর মুখ দেখে পদ্মা সেতু তাদের নিমিত্তে নিবেদন।
পদ্মা সেতুর অবকাঠামোগত রূপঃ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পকে সার্থক করতে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ৯১৮ হেক্টরেরও বেশি। এবং সেতু তৈরীতে যেসব উপাদান ব্যবহারে আধিক্য লক্ষ্য করা যায়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কংক্রিট ,স্টীল এবং ধাতব পাত। ৪২ খুঁটির উপরে বসেছে ৪১ স্প্যান। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১ স্প্যানের সমন্বয়ে দৃশ্যমান হয় মোট ৬.১৫ কিলোমিটারের মূল সেতু। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
তত্ত্বাবধানঃ পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রত বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলেও নির্মাণ কার্যক্রমের সম্পূর্ণ তদারকিতে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিট। এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রে মনোনীত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রীজ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
নদীশাসনঃ দুই প্রান্তের ১২ কিলোমিটার অঞ্চলকে নদীশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো এবং নদীশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল চীনেরই ভিন্ন এক কোম্পানি, যার নাম সিনা হাইড্রো কর্পোরেশন।
নির্মাণ ইতিহাসঃ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় এক নির্ভরতা নৌযান। স্থলপথেও নিয়মিত রাজধানীসহ বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করে হাজারো মানুষ (ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষাধিক বটে)। আর মাঝপথে পদ্মা পারাপারের সবথেকে নির্ভরযোগ্য ভরসা ফেরী।কারো পছন্দ স্পীডবোট কিংবা লঞ্চ। মাল পরিবহন হোক কিংবা হোক যাত্রী পরিবহণ, ফেরীর সংখ্যা অপ্রতুলতা, আবহাওয়া, পারাপার জটিলতা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রত্যক্ষ ভোগান্তি আর নিদারুণ উল্লেখযোগ্যভাবে সময় বাঁচানোসহ দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াসই পদ্মা সেতু।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর নকশা প্রণয়নে এ ই সি ও এম এর অধীনে দেশের বিশেষজ্ঞ , জাতীয় পরামর্শক এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের সেতু নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। বিশেষায়িত এ কমিটির প্রণীত নকশাকে কেন্দ্র করেই ইংরেজী ২০১১ সালে সেতুর নির্মাণকাজ আরম্ভ আর ২০১৩ তে সমাপ্তির কথা থাকলেও প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে বিশ্বব্যাংক পুরো সেতু তৈরিতে যে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে এবং একই সাথে অন্যান্য দাতা দেশ এবং সংস্থাগুলিও মুখ ফিরিয়ে নিলে কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলে কানাডার আদালত বাতিল করে দেয় মামলাটি আর সেই সাথেই আভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে ইতিহাস রচনায় অগ্রসর হয় বাংলাদেশ।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪ জুলাই তবে পরিকল্পনা বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাশ করে ২০০৭ সালে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইংরেজী ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট সর্ব প্রথম পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নামে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে কয়েকশো বছর এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণের ১০,১৬১ কোটি টাকার এক বৃহৎ পরিসরের প্রকল্প সংসদে তোলে এবং পাশ ও করে। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলালে, বদলায় সরকার আর সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে দুর্নীতির। আর সেই প্রশ্নেই স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো প্রকল্প। কিন্তু দুর্নীতির কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ফের শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রম, তবে এবার সম্পূর্ণভাবে নতুন সরকা্রের (আওয়ামী লীগ) উদ্যোগে।
তারা এসে প্রথম দফায় ব্যয় সংশোধন করে বাজেট বৃদ্ধি করে এবং মোট প্রকল্প ব্যয় ধরে ২০,৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়ে যাবার কারন কি তবে? হ্যাঁ, তারা এসে মূল পরিকল্পনার সাথে যুক্ত করে রেলপথ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বাজেট বৃদ্ধি করতে হয় আরেক দফা, যে দফায় বৃদ্ধি পায় প্রায় আত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে মোট অনুমিত ব্যায়ের পরিমাণ ২৮,৭৯৩ কটি টাকা। সবশেষ খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে, ৩০,১৯৩ কোটি টাকা। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে প্রকল্প গুছিয়ে আনতে আরো এক দফা বাজেট বাড়ানো হবে বলেই জানানো হয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্র থেকে। খরচ সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত এই খরচের পেছনে অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে নদীর স্রোত, গভীরতা আর দৈবিক মোড়ের সাথে পরিকল্পনার অসামাঞ্জস্যতাকে। উল্লেখ্য, একবার পদ্মা সেতুর রেল সংযোগে ত্রুটি ধরা পড়লে পুরো পরিকল্পনাই আবার নতুন করে ঢেলে সাজাতে হয়েছিলো ত্রুটি নিরসনে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রকল্প সফলভাবে এবং সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে প্রথমবারের মতো প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে ইংরেজী ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে।
দুর্নীতি অভিযোগ, অর্থায়ন জটিলতা, নকশা প্রণয়নে জটিলতা; তদসত্ত্বেও, ২০১৪ সালের ৭ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হয় যুগান্তকারী প্রকল্প “পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের” অধীনে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ কার্যক্রম।
সীমাবদ্ধতাকে জয়ঃ
সর্বশেষ স্প্যানটি বসার পূর্বে কারিগরি ত্রুটির আশঙ্কা থাকলেও পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হয় ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২০। শীতকালীন ঘন কুয়াশার ফলেই বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ইতিহাস রচনা করা পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসাতে। এবং, সর্বশেষ ৪১ নম্বর স্প্যানটি বসে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তকে উদযাপন করার বহুমুখী পরিকল্পনা থাকলেও অনেকটা অনাড়ম্বরভাবেই স্প্যান বসানোর কাজ সম্পন্ন করা হয়।
নির্মাণ পর্যায়, জটিলতা ও ভায়াডাক্টঃ
পদ্মা সেতুতে মোট খুঁটির সংখ্যা ৪২ টি, ৪২ খুঁটির উপরে মোট স্প্যান বসানো হয় ৪১ টি। খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিলো ইংরেজী ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।প্রথম স্প্যানটি বসানোর পরে বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে কর্তৃপক্ষের সময় লেগে গিয়েছিলো প্রায় তিন বছর দুই মাস।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ও বন্যার অত্যধিক স্রোত পদ্মা সেতুর কাজে কিছুটা গতি কমিয়ে দেয়। করোনার ক্ষতি কমাতে প্রকল্প এলাকা পুরোপুরি লকডাউন করা হয়। অর্থাৎ শ্রমিক ও প্রকৌশলী যাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রকল্প এলাকা থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। নদীর দুই পাড়ে দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর বন্যার সময় বসাতে না পারলেও বাকি সব স্প্যান প্রস্তুত রাখার কাজ করা হয়। করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে ১১ অক্টোবর ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া গেছে। কারিগরি কোনো জটিলতাও তৈরি হয়নি। ফলে, টানা বাকি ১০টি স্প্যান বসানো সম্ভব হয়েছে।
পদ্মার মূল সেতু সংযোগ ঘটবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে।
মাদারীপুরের শিবচর অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে সেতুর টোলপ্লাজা, উল্লেখ্য, সেখানে সংযোগ সড়কসহ আরও বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই আশেপাশের অঞ্চলে একটা রমরমা ভাব বিরাজ করছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে তিন জেলা আর ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে পুরো দেশের অর্থনীতি। সেতুর নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ১৫০ মিটার দীর্ঘ প্রতিটি স্প্যান দিয়ে সেতুটি জোড়া লাগানো হচ্ছে। ৪২টি খুঁটির ওপর বসানো হয়েছে ৪১ স্প্যান। অবশ্য দুই পারে আরও প্রায় চার কিলোমিটার সেতু সংযোগ প্রান্তি তথা ভায়াডাক্ট মূল সেতু নির্মাণের বেশ পূর্বেই নির্মাণ হয়ে গেছে। এবং বিশেষায়িতভাবে ভায়াডাক্ট তৈরিতে কোনো স্টীলের স্প্যান ব্যবহার করা হয়নি!
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাবঃ
পদ্মা সেতু প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা মাত্রই ধীরে ধীরে দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূলভাবে বদলে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞ্ররা মত দিয়েছেন। ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে, এমন আশ্বাসই পাওয়া যায় বিশেষজ্ঞ মহল থেকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ স্থাপিত হবে সরাসরি। স্থলবন্দরগুলোর সাথে রাজধানী আর বন্দরনগরীর সাথে সংযোগ স্থাপিত হলে তা যে ঠিক কতো বছর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে দেশের অর্থনীতি তা বলাই বাহুল্য। সার্বিকভাবে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তি বহুলাংশেই কমিয়ে আনবে! এমন অজানা বহু কাহিনী আছে, যেখানে ফেরী সমস্যায় অ্যাম্বুলেন্স সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারায় মৃত্যুবরণ করেছে হাজারো মানূষ গত কয়েক দশকে। হয়তো এমনভাবে কাউকে আর মরতে হবেনা! পুরো রাজধানীই হয়তো সার্বিক চাপ থেকে কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচবে আর সুবিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়ে সেই সঙ্গে সঙ্গেই।
এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যান চলাচলের ঘন আধিক্য নিরূপণ করতে বিস্তর এক সমীক্ষা চালায়।যে সমীক্ষায় জানা যায়, , ২০২২ সালের শুরুতে যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়, তাহলে ২০২২ সালেই সেতুর উপরে চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। এবং এই যান চলাচলের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারেই বাড়তে থাকবে। ধারণা করা হয় যে, ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৬৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে পদ্মা বহুমুখী সেতুর উপর দিয়ে।
২০২০ সালের ১২ ই ডিসেম্বর সেতুর উপর সর্বশেষ স্প্যান বসলেও সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ২০২১ সালের ডিসম্বরে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে সবার জন্য। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়,পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর যাতায়াতে গড়ে দু ঘণ্টা সময় বেঁচে যাবে যা শুধু আভ্যন্তরীণই নয় বরঞ্চ একই সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থায়ও বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করবে। যান চলাচলের হার ক্রমাগত যত বাড়বে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেরও ঠিক ততোই প্রসার ঘটবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে আদৌ কোনো লাভ হতে পারে কিনা, তা নিয়ে ২০০৯ সালে ভিন্ন এক সমীক্ষা করে এডিবি ও জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।যে সমীক্ষায় উঠে আসে, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে যা অপ্রত্যাশিতভাবেই বেড়ে যেতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু এক স্বতন্ত্র আকর্ষণ বয়ে আনে। অনেকটা বহু আকাঙ্ক্ষিত আরাধ্য কিছু স্বর্গ থেকে এসে ধরা দেবার মতোন। এ অঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠী সেতু হবার ফলে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই পারে। কারন এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা হবে। দিন শেষে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপরে যা রীতিমতো পুরো দক্ষিণাঞ্চলেই এক বিষ্ময়কর পরিবর্তন আনবে। জীবনমান বেড়ে যাবে আর জীবন মানের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে অর্থনীতি।
সেতু নির্মাণ পরবর্তী তত্ত্বাবধানঃ
শুধুমাত্র সেতুকে কেন্দ্র করেই যেহেতু পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, সেতু সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতেও বহু স্থাপনা তৈরি হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে, সেহেতু শুধুমাত্র সেতু তত্ত্বাবধানেই পুরো একটা সামরিক ব্রিগেড তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বৈকি! সেতু নির্মাণ পরবর্তী তত্ত্বাবধানে থাকবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সামরিক প্লাটুন ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড । আর এই ব্রিগেডসহ তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত অন্য সকল সামরিক কলাকুশলী এবং সংশ্লিষ্টদের স্বার্থে নির্মাণাধীন আছে সামরিক সেনানিবাস (মুন্সিগঞ্জ এবং শরীয়তপুর অঞ্চল সংলগ্ন এলাকায়)। পদ্মা সেতুর নামেই নামকরণ করা হয় এই সেনানিবাসের।
সেতুকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া গুজবঃ
- সেতু নির্মাণে মানব খুলি প্রয়োজন।
- শিশুদের মাথা এবং রক্ত দিয়ে পূজা দিয়ে শুরু হয় সেতুর নির্মাণ কাজ।
- দেশে বিভিন্ন জায়গায় হুজুগে অপহরণকারী সন্দেহে গণধোলাইয়ের নজির দেখা যায়।
- মানসিক ভারসাম্যহীনদেরকে অপহরণকারী বিবেচনায় পুলিশে হস্তান্তরের বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে।
পরবর্তীতে এসব ঘটনাকে গুজব ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ৯ জুলাই ২০১৯ তারিখে সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞপ্তি পাঠায়।
সেতু নির্ভর মেগা প্রকল্পঃ
সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকা- যশোর রেলপথ সংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিন্তা চলছে। সেতু নির্ভর আরেকটা মেগা প্রোজেক্টের উদাহরণ এটি যা অর্থনীতিক গতিশীলতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন বলে বিবেচনা করা যায়।
ঘুষ কেলেঙ্কারি বিজয়ঃ ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ (চার মাইল) সড়ক-রেল সেতুর জন্য $ ১.২ বিলিয়ন (৭৬৪ মিলিয়ন পাউন্ড) ঋণ দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল করে দেয় বিশ্ব ব্যাংক । বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য অংশীদার দাতারা বেশ কয়েকবার দফায় দফায় বাংলাদেশে প্রতিনিধি পাঠায় সঠিক তদন্ত এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে! কিন্তু বাংলাদেশ পক্ষ থেকে কোনো সন্তোষজনক সদুত্তর না থাকায় $ ১.২ বিলিয়ন (৭৬৪ মিলিয়ন পাউন্ড) ঋণ বাতিল করে দেয় এবং তারা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলোর একটিও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি এবং কানাডীয় আদালত সংশ্লিষ্ট মামলাটি খারিজ করে দেয় এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব অর্থায়নেই তৈরি হয় পদ্মা সেতু!
লেখাঃ নিয়াজ মাহমুদ সাকিব