নিয়াজ মাহমুদ সাকিব
অত্যাধুনিক জৈব প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব থেকে জীববৈচিত্র্য রক্ষার নিমিত্তে এবং জৈব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ইংরেজী ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারিতে কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়া “জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ” সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হওয়া অবিসংবাদিত চুক্তিই ‘কার্টাহেনা প্রোটকল’। খসড়া চুক্তির অনুচ্ছেদ ৩৭ অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয় চুক্তিটি এবং এই চুক্তিতে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১৭৩ টি রাষ্ট্র স্বাক্ষর করে, যার মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের ১৭০ টি সদস্য রাষ্ট্র এবং দ্য স্টেইট অফ প্যালেস্টাইন, নিউই এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এই প্রোটোকলে স্বাক্ষর করে ২০০০ সালের ২৪ মে।
আইনগত ভাবে, জৈব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কার্টাহেনা প্রোটোকল একটি বাধ্যবাধকতামূলক বৈশ্বিক চুক্তি? কীসের বাধ্যবাধকতা? হ্যাঁ, জানতে হলে লেখাটা আপনার জন্যই!
হতে পারে উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া অথবা অন্য যেকোনো কিছু।অনেক কিছুরই তো নতুন নতুন জাত অত্যাধুনিক জৈব প্রযুক্তির সাহায্যে উদ্ভাবন করি। যেমন- ত্রিপত্রোত্পাদী, টমেটো, ভূট্টার জাত ইত্যাদি।
এরকমই আধুনিক জৈব প্রযুক্তির সাহায্যে উদ্ভাবিত কিংবা সৃষ্ট জিনগতভাবে সংশোধিত কিংবা পরিবর্তিত যেসব উদ্ভিদ-জীব তথা পণ্য জীব বৈচিত্র্য কিংবা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেসবের বৈধ আমদানি-রপ্তানি, নিরাপদ স্থানান্তর, সঠিক পরিচালনা ও ব্যবহার নিশ্চিতেই সূচনা হয়েছিলো “কার্টাহেনা প্রোটোকলের।
সহস্রাব্দ থেকেই নতুন নতুন বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের জন্য কৃষকেরা সবথেকে উন্নত গুণাবলীসম্পন্ন ফলনসই বীজ ও ভ্রূণগুলো বাছাই করে করে সংরক্ষণ করছে।
আধুনিক জৈব প্রযুক্তির কৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অণুজীবের জিন সন্নিবেশ করতে, সরাতে কিংবা সংশোধন করতে পারছেন,যার ফলে উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন সব লিভিং মডিফাইড অরগ্যানিজম (উদ্ভিদ-জীবের জিনোম সিকোয়েন্স সংশোধন কিংবা পরিবর্তনে প্রাপ্ত রূপ তথা নতুন কোনো স্বত্বা, যা কিনা ল্যাবেই মানবকল্যাণের স্বার্থে প্রাকৃতিক সাহায্যে কৃত্তিমভাবে তৈরি করা সম্ভবপর)।
জীবের পরিবর্তিত এই রূপ আদতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড তথা জিনগতভাবে পরিবর্তিত কিংবা সংশোধিত উদ্ভিদ-জীবসমূহের প্রতিবিম্ব এবং একই সাথে খাদ্য, ভ্যাকসিন এবং গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আধুনিক জৈব প্রযুক্তি কিন্তু মানবকল্যাণে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি দিক। উদাহরণস্বরূপ- উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পূর্বক খাদ্য চাহিদা মেটাতে এর ভূমিকা কিংবা মডিফাইড ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধে জৈব প্রযুক্তির গুরুত্ব।
তবে, জিনগতভাবে সংশোধিত তথা পরিবর্তিত উদ্ভিদ জীব কিংবা অণুজীবগুলো জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকির কারন হয়ে দাড়াতে পারে।
ক্ষতিকর দিকসমূহের উদাহরণস্বরূপ- অন্যান্য উদ্ভিদ জীবগুলোতে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি পৌঁছানো, সুপার উইড এর বিবর্তন ঘটানো, জীব জগতের অন্যান্য জীব সমূহের সাথে জিনের অপ্রত্যাশিত বদল তথা স্থানান্তর, খাবারে অ্যালারজির অতি উপস্থিতি এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতায় বাজে প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এবং জিনগতভাবে পরিবর্তিত এসব জীব কিংবা অণুজীব যেসব ক্ষতি পৌঁছাতে পারে, সে সমস্ত ক্ষতির ব্যাপারে উদ্বেগের ফলশ্রুতিতেই, ইংরেজী ২০০০ সালের জানুয়ারীতে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার সম্মিলিতভাবে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা সম্মেলনে জৈব সুরক্ষায় যে আন্তর্জাতিক চুক্তি গ্রহণে সম্মত হয়েছিলো, তাই কার্টাহেনা প্রোটোকল।
প্রোটকলটি এক দেশ থেকে অন্য দেশে জিনগতভাবে সংশোধিত কিংবা পরিবর্তিত জীব তথা পণ্যসমূহের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমদানির পূর্বে কোনো জীব/পণ্যের ব্যাপারে আদ্যোপান্ত জেনে সে পণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নেবার সুবিধা নিশ্চিত করে।
পরিবেশে কোনো জি এম ও পণ্য (জিনগতভাবে পরিবর্তিত উদ্ভিদ-জীব,অণুজীব তথা পণ্য) মুক্ত করার পূর্বে অবশ্যই অবশ্যই তা পরীক্ষা নিরীক্ষাপূর্বক মূল্যায়ন করতে হবে। যদি কোনো ঝুঁকি শণাক্ত হয়, তবে সে ঝুঁকি মুক্ত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। এবং যদি কোনোকিছুতেই সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকি নিরাময় সম্ভব না হয়, তাহলে কি ই বা আর করার আছে!
কিন্তু সবকিছু জেনে শুনেও কোনো দেশ যদি তা আমদানি করতে চায়, সে দেশ ঝুঁকির ব্যাপারে সমস্ত খুঁটিনাটি জেনে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ অধিকার রাখবে এবং অন্য সব পক্ষকে রপ্তানিকারক দেশ সকল খুঁটিনাটি বিবরণী প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবে এবং একই সাথে সবকিছু জেনে যদি কেউ কোনোকিছু আমদানি করে, তাহলে সম্পূর্ণ নিজেদের দায়িত্বেই তা আমদানি করতে হবে। যার ফলে, এই মর্মে অন্য কাউকে দায়ী করার সুযোগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এবং যথাযথভাবে দালিলিক প্রমাণাদি রক্ষা করে এসমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা সকল সরকারেরই নৈতিক দায়িত্ব।
প্রোটোকলে এছাড়াও বলা আছে , সকল সরকারকেই যেকোনো এল এম ও, জি এম ও (জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব,উদ্ভিদ, অণুজীব তথা যেকোনো জি এম ও পণ্যের) ব্যাপারে বৃহত্তর পরিসরে জনসচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো জিপজী (জিনগতোভাবে পরিবর্তিত পণ্যের) ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণকে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং জনমতকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
বায়োসেইফটি ক্লিয়ারিং হাউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক একটি প্রক্রিয়াও আছে,যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সাধারণত কোনো জিপজী কিংবা জিপপ (জিনগতভাবে পরিবর্তিত পণ্য) ক্লিয়ারেন্স পেয়ে থাকে এবং এই প্রতিষ্ঠানই সর্বসমক্ষে যেকোনো পণ্যের ইতিবৃত্ত উপস্থাপন করে থাকে। এবং প্রতিষ্ঠানটি সর্ব সম্মতিক্রমেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবেশ অধিদপ্তর, জৈব সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রস্তাবিত ও বিশ্বব্যাপী গৃহীত কার্টাহেনা প্রোটোকলটি দেশে বাস্তবায়নের স্বার্থে একাধিক উন্নয়নমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
ইউএনইপি-জিইএফ-এর সহায়তায় ২০০৪-২০০৬ এর মাঝামাঝি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম উদ্যোগটি ছিল ‘ন্যাশনাল বায়োসফটি ফ্রেমওয়ার্কের উন্নয়ন (এনবিএফ)’। প্রযুক্তিগত সহায়তার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থথে এনবিএফ এর কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশে।২০০৬-২০০৭ এ বাংলাদেশ ‘বায়ো সেইফটি ক্লিয়ারিং হাউস (বিসিএইচ) নিজেদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে “বিল্ডিং ক্যাপাসিটি’” শীর্ষক ইউ এন ই পি-জি ই এফ গ্লোবাল প্রকল্পেও অংশ নিয়েছিল। এই বিবিসিএইচ (বাংলাদেশ বায়ো সেইফটি ক্লিয়ারিং হাউজ) মূলত সুদক্ষ জনবল তৈরী এবং সুনিপুণতার সাথে কার্যাদি পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে, দেশটি ২০১৪-২০১৬ সালের প্রস্তাবিত ‘ ন্যাশনাল বায়োসফটি ফ্রেমওয়ার্ক (আইএনবিএফ) বাস্তবায়নে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে উদ্যমী হয় এবং পুরোনো ফ্রেমওয়ার্ক থেকে সরে আসে।
এই প্রোটোকলের কারনেই অল্প চালানের আমদানি-রপ্তানি খানিকটা কমে গেছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কারন প্রচুর পরিমাণ চালানের প্রয়োজন তো আছেই বটে, তার উপরে যদি ভূট্টা, সয়াবিনজাতীয় পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যসমূহ , যা কিনা খাদ্য কিংবা গবাদিপশুর খাদ্য অথবা কোনো দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হতে পারে, সে সমস্ত পণ্যের চালানে “এই পণ্যে জি এম ও (জিনগতোভাবে পরিবর্তিত জীব কিংবা পণ্যের) উপস্থিতি থাকতে পারে যা কোনোভাবেই উদ্দেশ্যমূলক নয়” মর্মে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। এবং বাকিদেরকেও তা মেনে নিয়েই সে পণ্য আমদানি করতে হবে।
প্রোটোকলটিতে এমন একটি আলাদা ধারাই রয়েছে , যে ধারায়, যেকোনো পক্ষের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট উল্লেখ করার মর্মে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, এবং একই সাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কোনো সদস্য রাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য বিদ্যমান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যেকোনো সরকারকে কোনোরূপ হয়রানির অংশ না করতে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। কারো অধিকার খর্ব না করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া আছে এবং সকল রাষ্ট্রেরই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয় ।
প্রোটোকলটি ৫০ তম রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমন্বয় ইউনিট কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণার ৯০ দিন পর থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো বলে উল্লেখ আছে। ২০০২ সালের জুন পর্যন্ত ১০৩ টি দেশ স্বাক্ষর করলেও কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছিলো মাত্র ২১ টি দেশ। যখনই কোনো রাষ্ট্র কোনো প্রোটোকলে স্বাক্ষর করে, সে স্বাক্ষরের অর্থ হচ্ছে, ঐ রাষ্ট্র ঐ প্রোটোকলকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে, নীতিগতোভাবে বৈধতা দেয় এবং অনুমোদনে ও কার্যক্রম সুন্দর ও সফলভাবে পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আর এই ধরনের প্রোটোকলগুলো কোনো রাষ্ট্র জাতিসংঘের কাছে স্বাক্ষর সমেত অনুমোদনের কোনো খসড়া কিংবা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিপত্র জমা দেয়া মাত্রই ওই রাষ্ট্রের উপর প্রোটোকল আইনগতভাবে বলবৎ হয়ে যায়।
পৃথিবীতে জীবজগতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর এবং এই কার্টাহেনা প্রোটোকল জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণে নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এবং আপনিও কিন্তু কার্টাহেনা প্রোটোকল এবং এই প্রোটোকলের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন সঠিক তথ্য প্রদান, যাচাই এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সরকারকে সহায়তা করার মাধ্যমে। মা নিয়ে উক্তি