কষ্ট : খুব ছোট্ট করে বলতে গেলে কষ্টের মানে খারাপ লাগা। হঠাৎ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অনুভূতি। কষ্ট বলতে দুঃখ, মন খারাপ হওয়া, ভালো না লাগা, শোক পালন করা, কারো অভাববোধ- সব বোঝায়। কষ্টেরও রকমফের আছে। মনের কষ্ট, আছে শরীরের কষ্ট। কষ্টের উৎস হয় অনেকরকম। আপনজনের বিচ্ছেদের কষ্ট, কারো করা অপমানের কষ্ট, কারো দেয়া আঘাতের কষ্ট। আবার মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত আছে আনন্দের কষ্ট। তীব্র আনন্দ এনে দেয় বাঁধ-ভাঙা অশ্রু। তারসাথে মিশে থাকে অনেকদিনের করে আসা সংগ্রামের গল্প, পিছনে ফেলে আসা যন্ত্রণার কথা। কষ্ট এমন একটি অনুভূতি, যার অনেকগুলো শাখা রয়েছে। অনেকরকম গল্প থাকে এই অনুভূতির পেছনে।
কষ্টের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা কী? মস্তিষ্ক প্রচন্ড চাপ অনুভব করে এই সময়। হরমোনাল ইমব্যাল্যান্স থেকে শুরু করে অনেকসময় বায়োলজিক্যাল ক্লক এলোমেলো হয়ে যায়। কষ্ট অনুভব করলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়ার উপসর্গ দেখা যায়। খুব বেশিরকম কষ্টের জন্য মানুষ বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে, শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকে না। পায়ের ওপর ভারসাম্য হারিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অনেককিছু করে ফেলে সে। অনেকসময় মানুষ বুঝতেই পারে না সে কী করছে।
কষ্ট কেন পায় মানুষ? এই অনুভূতির উৎসই বা কী?
খুব বেশি করে কোনোকিছুর প্রতি মোহ থাকলে মানুষের বস্তুটির ওপর একরকম “অবসেশন” তৈরি হয়। কোনোভাবে সেই মোহভঙ্গ হলে সৃষ্টি হয় তীব্র কষ্ট। অতি আপনজনকে যখন কেউ ভালোবাসে, তার মৃত্যু দেয় চরম আঘাত। ভালোবাসার মানুষটি যখন হাত ছেড়ে চলে যায়, তখন জন্ম নেয় অপার্থিব মানসিক কষ্ট। সামর্থ্যের অভাবে প্রিয় কারো কোন ইচছা পূরণ করতে না পারলে ছুটে আসে বোবা কষ্ট। কষ্টের জন্ম সামর্থ্যের অভাব, তা সে কাউকে ধরে রাখতে না পারার সামর্থ্য, কারো মৃত্যু সহ্য করতে না পারার সামর্থ্য, কোনোকিছু অর্জন করতে না পারার সামর্থ্য, কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে না পারার সামর্থ্যই হোক না কেন। দিনশেষে এরকম ছোট থেকে বড় কোনো সামর্থ্যের অভাবই জন্ম দেয় কষ্টের।
কষ্টকে রাসায়নিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখা করতে চাইলে মনে হয় যেন খুব সাধারণ কোনো ব্যাপার। মস্তিষ্কে হরমোনাল ইমব্যালেন্স সৃষ্টি হলে মানুষের কষ্ট হয়। সেই ইমব্যালেন্স কেটে গেলেই আবার মানুষ কষ্ট ভুলে যাবে। আদতে ব্যাপার তা হয় না। কেউ কেউ সুদীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট পুষে রাখে। আবার কেউ বা কষ্ট না পেয়েও কষ্ট পাওয়ার ভান করে। জগত বড়ই রহস্যময়। কারো ব্যার্থতায় এমন কেউ কষ্ট পায় , যার হয়তো কোনো দরকারই ছিল না এমন শোক পালনের। আবার অনেক আপনজনেরাও ছেড়ে চলে যায় জীবনের সেরা কষ্টের সময়টাতে।
“এতটা নিঃশব্দে জেগে থাকা যায় না। তবু জেগে আছি- আরো কত শব্দহীন হাটবে তুমি, আরো কত নিভৃত চরণে, আমি কি কিছুই শুনব না? আমি কি কিছুই জানব না? “- রুদ্র শহীদুল্লাহ।
মানুষ হয়ে জন্মালে কষ্টের স্বাদ অনুভব করতেই হবে। আপনজনের বিচ্ছেদের কষ্টের মত তীব্র কষ্টও মানুষ হজম করে তোলে, নতুন করে হাসতে শেখে। মানুষের রয়েছে এক অদ্ভুত শক্তি। মস্তিষ্ক কখনো তীব্র যাতনা পুষে রাখতে দেয় না। মানুষকে নতুন করে বাঁচা শেখায়। নতুন করে শোকাহতের মধ্যে জাগিয়ে তোলে জীবনীশক্তি। মানুষ তাই চরম আঘাতও একসময় ভুলে যায়। আবার নতুন করে আশা জাগায় অন্যকিছু নিয়ে। বেঁচে থাকার তারণা সবচেয় বড় নিরাময় করে সব দুঃখের। বেঁচে থাকার প্রেষনার জন্য লাঘব হয় কষ্ট।
কিন্তু সবসময় কি তা হয়? সবসময় মানুষ কষ্ট ভোলে না, শোক পালন করে চলে ।
শহীদ আজাদের মা- এক মহীয়সী নারী। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আজাদ আর ফেরত আসে নাই। আজাদ মৃত্যুর আগের দিন জেলে তার মাকে বলেছিল, সে ভাত খেতে চায়। পরদিন মা ভাত রেঁধে নিয়ে গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। সে কোথায় কেউ জানে না। তাকে জেলখানা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজাদ আর ফেরেনি। সেই মাও আর সারাজীবন ভাত মুখে তোলেননি। শুয়েছেন মাটিতে। আজাদ যে আর ফেরত আসবেন না, তা বিশ্বাস করেননি তিনি। সারাজীবন অপেক্ষা করেছেন কবে আজাদ ফিরবে। অসুস্থতার সময়েও তাকে বিছানায় শোয়ানো যায়নি। মৃত্যুর পর তার কবর ফলকে “শহীদ আজাদের মা” লিখতে বলে গিয়েছেন। কষ্টের গভীরতা কতদূর তীব্র হলে এমন আজীবন কালাঙিনীর মত শোক পালন করা যায়?
কষ্ট , শোক, দুঃখ, যাতনা, বেদনা, কান্না- সবই একই নদীর নানা শাখা। যার অনুভব করার ক্ষমতা আছে, সেই কষ্ট পায়। ছোট্ট বাচ্চাটির খেলনার হারানোর কষ্ট আর জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষের দীর্ঘশ্বাসের কষ্ট; দিনশেষে মানুষ জন্ম আর মৃত্যুর পাশাপাশি কষ্টকেও অনুভব করতে শিখে নেয়।