বন্ধু : মানুষ সামাজিক জীব মানুষ, একা বেঁচে থাকতে পারেনা। প্রতিটি মানুষেরই মনের খোরাক যোগাতে প্রয়োজন অন্তত একজন বন্ধুর। বন্ধু হলো সে, যার সাথে যদি রক্তের বন্ধন না থকে, তাও থাকে আত্মার বন্ধন। বন্ধু মানেই এমন এক বন্ধন, যা মুক্তি দেয়, সুন্দর কিছু অনুভূতি আর পরপস্পরের সমঝোতায় গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বে প্রয়োজন বিশ্বাস, ভালবাসা, সম্মান। বন্ধুর কাছে মন খুলে বলা যায় সব কথা। থাকে না কোনো সন্দেহ । মত না মিললেও নেই অসম্মান বা তাচ্ছ্বিল্য।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে বন্ধুত্ব উন্নত মানসিকতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। বন্ধুবৎসল ব্যাক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বন্ধুবিহীন মানুষের অবসাদ ও বিষণ্মতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। মানসিক উন্নয়নে ও চরিত্র গঠনে পিতামাতার পরেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বন্ধু। বাচ্চাদের বন্ধুরা যদি হয় মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান ও রুচিশীল, তাহলে তাদের সঙ্গ বাচ্চাটিকে ভাবতে শেখায়, চিন্তা-ভাবনায় আনে বিচক্ষণতা। পরিবার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাই সৎ বন্ধুও প্রয়োজনীয়। বন্ধুবিহীন বাচ্চাদের পরবর্তীতে গিয়ে অসামাজিকতা আর নিঃসঙ্গতায় ভুগতে দেখা যায়।
বন্ধু যে শুধু সমবয়সীরাই হয় তা নয় । বন্ধুত্বের সংজ্ঞা জাত-পাত-বয়স মুক্ত। যে কেউ হতে পারে বন্ধু। বন্ধুর কাছে থাকে সব গোপন কথার চাবিকাঠি। মানুষের মস্তিষ্ক তাঁর নিঃষঙ্গ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় নিজে নিজে বন্ধু তৈরি করে নেয়। আবার, বন্ধু হতে পারে পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিটিও। বন্ধু হতে পারে পোষা প্রাণীটি, লালন-পালনকারী ব্যাক্তিটি। মা আর তাঁর কিশোরী বা তরুণী মেয়ে হয়ে ওঠে বন্ধু। তেমনি পিতা আর তাঁর ছেলে। মায়ের সাথে ছেলে কিংবা বাবার সাথে মেয়ের বন্ধুত্বও হয়। এই বন্ধুত্ব পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় আর অটুট করে তোলে। বর্তমান যুগে সন্তানের সাথে মা-বাবার যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তা দূর করে।
বন্ধুত্ব হয় অনেকরকমের। ছোট্টবেলার খেলার সাথীরাই হয় বন্ধু। তখন ব্যাক্তিগত পরিসর বলতে তেমনকিছু থাকে না। শিশুর সাথে সব খেলার সাথীরই বন্ধুত্ব হয়। আস্তে আস্তে কিশোর বয়সে এসে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা কমে। তখন সাময়িক বন্ধুত্বের প্রবণতা দেখা যায়। কারোশাথে কথা বলে ভাল লাগলে তাকে বন্ধু ধরে নিয়ে অনবরত কথা বলা, সব বিষয় ভাগাভাগি করা, পরামর্শ চাওয়া- এসব করে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কিছুদিন পর ভেঙে যায়।
বয়স যত বাড়ে তার সাথে সাথে বন্ধুর সংখ্যা কমে যায়। নিজেদের জগত তৈরি হয় সকলের। সেই জগতে খুব বেশি কেউ আসার অনুমতি পায়না। অনেকসময় ব্যাস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যায় বন্ধুত্ব। দিনের পর দিন গড়ায়। আগের মত তেমন কথা বলা, সময় কাটানো হয়ে ওঠে না আর। আস্তে আস্তে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হঠাত হয়তো কোথাও যাওয়ার সময় দেখা হলে আবার স্মৃতির কোণ থেকে পুরোনো বন্ধুত্ব জেগে ওঠে। ছাত্রজীবন বা কৈশোর তারুণ্যের সময় ছেলে-মেয়েরা লাজুক হয়। পরিবারের সবার সাথে হয়তো আগের মত মেশা হয় না। তখন সবকাজে সাহায্য করে এই বন্ধুরাই। মা, বাবা, ভাই-বোনের পরে
সব বিপদে এগিয়ে আসে, বুক আগলে দাঁড়ায় বন্ধুরাই।
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে বন্ধুত্ব তিনরকমের। স্বার্থের বন্ধুত্ব, আবেগের বন্ধুত্ব আর কামনার বন্ধুত্ব। আবেগের বন্ধুত্বের মধ্যে সেই কৈশোর বয়সের বন্ধুরা কিংবা বিপরীত লিঙ্গের সাথে হওয়া বন্ধুত্ব রয়েছে। যার ফলে জীবনের বেশকিছু পর্যায় নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বার্থের বন্ধুদের চেনা দায়। সুসময়ের দুধের মাছিরা এরকম বন্ধুত্ব দেখায়। পরে সুবিধা করতে না পারলে ঠিকই ঝড়ে যায়। আর কামনার বন্ধুত্বও সেই স্বার্থের বন্ধুত্বের মতই ক্ষতিকর।
ব্রিটেনে ওবিসিটি সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে বন্ধুহীন জীবন দ্রুত বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যায়। গ্রাস করে বিষাদ। বার্ধক্যে সময় কাটাতে এই বন্ধুত্ব খুবই প্রয়োজনীয়। নিজের কর্মজীবন হয়তো শেষ হয়ে গিয়েছে, কথা বলার মত কাউকে পাওয়াও দায়। এমনসময় বন্ধুরা খুব কাজে দেয়। সে বন্ধু হতে পারে নিজের স্বামী কিংবা স্ত্রী, আবার পাড়ার পরিচিত অন্যান্য বৃদ্ধরা।
বন্ধু চিনে নিতে তেমনকিছু লাগে না। যে বন্ধু, যে আসলেই ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে এসেছে, সে কখনো চাটুকারিতা করবে না। যা ভাল লাগবে, তাকে ভালো আর যে আচরণ তার খারাপ লাগবে, তাকে সে খারাপই বলবে। সত্যিকারের বন্ধুর চোখে বন্ধুর সফলতায় হিংসা না, আন্তরিক গর্ব দেখা যায়। বিপদে ছুটে আসে এই বন্ধুরাই। সৎ বন্ধু খারাপ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, খারাপ কাজে আপনার মন রাখার জন্যে সায় দেবে না। কোনো খারাপ সঙ্গের পাল্লায় পরলে আপনাকে সেখান থেকে টেনে আনার চেস্টা করবে। প্রথমে অনেকেরই তাকে হিংসে মনে হতে পারে। কিন্তু একদিন ঠিকই বোধ ফিরে আসে।
“একটি বই একশটি বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভাল বন্ধু একশটি লাইব্রেরির সমান।“- এপিজে আব্দুল কালাম আজাদ।
“অন্ধকারে একজন বন্ধুর সাথে হাঁটা, আলোতে একলা হাটার চেয়ে উত্তম।“ –হেলেন কিলার।
বন্ধুত্ব থাকুক অমলিন, বন্ধুরা হোক সামনে এগোনোর প্রেরণাদায়ী প্রদীপ।