সিক্স মেশিনঃ এক দানবের উত্থান উপাখ্যান (ক্রিকেটীয়)

 

নিয়াজ মাহমুদ সাকিব

সিক্স মেশিন, ছয়টা ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কথা বলছি? না! তবে কি এই সিক্স মেশিন ছয়টা বিশেষ রোবট ? যারা পুরো দুনিয়ার মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজেরা রাজ করতে এসেছে! নাকি মানুষকে বিনোদনে আনন্দে মাতিয়ে রাখতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ৬ রোবট? হ্যাঁ ,এই সিক্স মেশিন মানুষকে আনন্দ দেয় ,বিনোদন দেয়, দুঃখ ভুলে থাকার ফুসরত দেয়। এই ‘সিক্স মেশিন’ অন্য কেউ নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান’ ক্রিকেটীয় দানব ক্রিস গেইল। তিনি সিক্স মেশিন হিসেবেই আমাদের কাছে বেশি সুপরিচিত। এবং তারই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম “সিক্স মেশিন: আই ডোন্ট লাইক ক্রিকেট , আই লাভ ক্রিকেট”!

বইটির সবকিছুই আপনাকে দেবে ভিন্ন এক স্বাদ। যে স্বাদ আহরণে আপনি অবগাহন করতে পারেন নীললোহিতের অন্তরালে, ডুব দিতে পারেন ক্রিকেট ঈশ্বরের আশীর্বাদের বরপুত্র ক্রিস্টফার হেনরি গেইলের আত্মজীবনীমূলক বই “সিক্স মেশিন” এর জীবনজলধিতে কল্লোলের ছন্দের সাথে নিজের অনুভুতিগুলোকে ভাসিয়ে দিয়ে অবলীলায়। 

 

“দ্যা ইউনিভার্স বস” খেতাবে নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা ক্রিস গেইল সম্প্রতি ১৩ জুলাই,২০২১ টি ২০ ক্রিকেটে ১৪০০০ রানের মাইল ফলক স্পর্শ করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং তিনিই এখন পর্যন্ত একমাত্র ক্রিকেটার ইতিহাসে যিনি টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাচের প্রথম বলেই ছয় মারার রেকর্ড ধরে রেখেছেন। 

তিনি অস্পৃশ্য, তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রেকর্ড বইয়ের অসংখ্য রেকর্ড এখন তাঁর নামের পাশে। খেলার মাঠে যেমন দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটি চলে তাঁর, মাঠের বাইরেও জীবনকে উপভোগ করার নাম ভাঙ্গিয়ে অতিমাত্রায় পার্টি করে বেড়ানোতে তাঁর জো নেই। 

রাতে ফুর্তি করবেন, ঘুমাবেন, সকালে তাঁর পছন্দের প্যানকেক দিয়ে নাস্তা করবেন এবং আবার সকালে উঠে নতুন একটা রেকর্ড ইনিংস খেলবেন। মানুষটা যে দানবীয় একেকটা ছয় মারে, শুধু তা নয়, এখন মানুষ তাঁর অতিদানবীয় ব্যাট, বিশাল রঙ্গিন চশমার ফ্রেম- খেলার মাঠেও-জীবনের মাঠেও এবং তাঁর চওড়া হাসির পৃথিবীর জন্যও ভালোবাসে। 

মজার মানুষ, নিবেদিত প্রাণ, আন্তরিক, আক্রমণাত্মক (খেলার মাঠে), ভয়ানক স্বেচ্ছাচারী (এই বিশেষণ ও তাঁর জন্য শুধুই  খেলার মাঠে প্রযোজ্য)। ভয়ানক স্বেচ্ছাচারী নয় তো কি! যেভাবে একেকটা বলকে বাউন্ডারি লাইন স্পর্শ করান, তা তো যে কেউ বলবে কাব্যিক ছন্দের উচ্ছলতা আর উদ্বেল। 

কতোটা সংগ্রাম, কতোটা বেদনা-বিধুর কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের দ্যা ইউনিভার্স বস, সেসবই মূলত লিখেছেন গেইল তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই সিক্স মেশিনে।  মজায় মজায় কৌতূকের ছলে জীবনের শুদ্ধতম দর্শন তুলে নিয়ে আসা ব্রায়ান লারার দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিন্ন চরিত্রের একা হাতে অসংখ্য বিজয়কাব্যগাঁথা রচনার নায়ক “ক্রিস গেইলের” অসামান্য কৃতিত্ব এবং তাঁর লেখক সত্ত্বার যোগ্য স্বীকৃতি। 

 

আত্মবিশ্বাসের রসদ জমা থাকে ব্যক্তিত্বে, চরিত্রে আর অভিজ্ঞতায় এবং ক্রিস গেইল নিঃসন্দেহে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি খুবই সংগ্রাম করতে থাকা, ধুকতে থাকা একটা পরিবার থেকে উঠে আসা আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বের মহীরূহ এ কথা তিনি কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ভোলেন নি। এমনকি তাঁর ২৮৮ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থেও তিনি এই কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। একজন দুর্দান্ত প্রতিভাবান ক্রিকেটার বলেই তিনি আজকের ক্রিস গেইল তবে তাঁর অতীতের সংগ্রাম তিনি যথার্থই মনে রেখেছেন, কারন গেইল যে এক দিগবিজয়ী বীর, তাঁর ছুটে চলা জলে,স্থলে, ব্যোমে কার রাজ্যপাট? ভাগ্যদেবীর সহায়তা আর তাঁর মা,ভাইদের অবদান , তাছাড়া এই বস , ইউনিভার্স বস’ চরিত্র পুরো বই জুড়েই ফুটে উঠেছে যা আপনার জন্য সুখপাঠ্য হতে যাচ্ছে। অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক কৌতূপোদ্দীপক গেইল যেন তাঁর স্বরূপ , তাঁর জ্যামাইকান মূর্তি, যেন নিজেকেই প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন বইটিতে। এ যেন এমন এক মহাদানবের আখ্যান , যিনি দানবীয় মূর্তিতে দিনে ছয় মারেন, বল আউট অফ দ্যা স্টেডিয়াম পাঠান, ক্ষুদ্র তাঁর জাতি সত্ত্বাকে গর্বিত করেন,   আবার রাতে ফুর্তি করে বেড়ান। খেলায় দানব আর খেলার মাঠের বাইরের ফুর্তি পান্ডব, এ যেন নিত্যদিনের চরিত্র গেইলের। 

 

বইটা ক্রিকেটের চেয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন, একেক সময়ে নেয়া একেকটা সিদ্ধান্ত এবং সেসব সিদ্ধান্তের বিস্তর ব্যাখ্যা নিয়েই বেশি কথা বলেছে। ব্যখ্যাটা কিছুক্ষেত্রে একটু বেশিই মনে হতে পারে পাঠকের কাছে, তবুও এটা তো আত্মজীবনী বৈ কিছুই নয়, তাই লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করাই বরং স্বাভাবিক।  যদিও পাঠক হিসেবে কেউ কেউ তাঁর থেকে আরো বেশি মাত্রায় ক্রিকেটীয় উপাখ্যানের প্রত্যাশা করে বসতেই পারেন,যেহেতু এতো বছরের অভিজ্ঞতা গেইলের।

 

এতে সেই আবহমান জ্যামাইকান গ্রাম্য দ্বীপের জীবনযাপনের আখ্যানও  ফুটে উঠেছে। আর কিছু হোক না হোক, এই প্রজন্মের অন্যতম বিনোদনমূলক এই ক্রিকেটারের জীবনাখ্যানের পরতে পরতে পৌছে যেতে পারবেন আপনি, অনুভব করতে পারবেন আরো গভীর থেকে। খুবই ভিন্নভাবে লেখা একটা বই। প্রথার বাইরে গিয়ে লেখা একটা বই! হ্যা। প্রথাগত সবকিছুর বাইরে! কারন এটা যে গেইল আর ক্রিস্টফার হেনরি গেইল যে এমনই। প্রথার বাইরের বটে তবু কাজের সময়ে যাকে পাওয়া যায়। 

 

বইয়ের সেরা অংশগুলো হলো তিনি যখন তাঁর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আর নিদারুণ নিষ্ঠুর শৈশবের কথা বলেন; নেতৃত্ব , জীবন আর দর্শন নিয়ে তাঁর যে আলাপ, তা আপনি নীরবে নিভৃতে নিশ্চিন্তে এড়িয়ে যেতে পারেন, সাথে তাঁর শ্লেষ মাখা বিদ্রূপ আর চাইলে তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনকে তাঁর ব্যক্তিগত হিসেবেই রেখে দিতে পারেন। ক্যারিবীয় কথোপকথনের ধরনেও আপনি খানিকটা বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন তবে তা আপনাকে বই ছেড়ে অন্য কোথাও মনোনিবেশ করবার সুযোগ অবশ্যই দেবেনা। 

 

বিশেষত্বে , মেজাজে, মননে, নিজস্ব চিন্তা চেতনায় গেইল এক অনন্য ব্যক্তিত্ব যার পুরোটাই ফুটে উঠেছে সিক্স মেশিনে। যদিও খেলার মাঠেও দৌড়াতে পছন্দ করেন কম, তবুও টেস্ট ম্যাচে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় ব্যক্তিগত ইনিংস আছে তাঁর ঝুলিতে। তদুপরি, বইটিতে গেইলের জীবনের ঘটনাবলীর কালানুক্রমিক বর্ণনা করা হয়নি , যে কারনে যেখান থেকেই শুরু করুন না কেন, একেবারে তাজা লাগবে ঘটনাগুলো। কিছু গল্প সত্যিই যৎপরোনাস্তি উল্লসিত রাখবে আপনাকে। উল্লেখ করতে গেলে বলতে হয় আন্দ্রে নীলের “গুন্থার” এর গল্পটা। 

 

সিক্স মেশিন আমাদেরকে নিয়ে গেছে তাঁর জীবনের প্রথম আবাসস্থল জ্যামাইকার ছোট্ট সেই গ্রামে , যেখানে তিনি বাড়ির থেকে মাঠে ঘাটেই দিন কাটিয়েছেন বেশি; স্থানীয় ক্রিকেট দলে তাঁর অধিভুক্তি, সে সময়ের দিনগুলো; ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলে তাঁর অভিষেক, ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর যাত্রা; টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তার আধিপত্য; তাঁর সমালোচক; তাঁর পার্টি করার স্টাইল সহ আরও অনেক কিছু।

 

গেইল বইটিতে তাঁর জ্যামাইকান চাকচিক্যকে বহন করেছেন, জ্যামাইকান সমারোহে গাঁ ভাসিয়েছেন, যা তাঁর স্বতন্ত্র আকর্ষণ বহন করে। প্রকাশ আর সততার ভঙ্গিমাও উন্মুক্ত বিচরিত বইতে আর তাছাড়া ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অসহায় আত্মসমর্পণ। সে তো স্বাভাবিকই বটে। তবে গেইল তাঁর নিজস্ব চিন্তা চেতনা- দর্শন নিয়ে কথা বলেছেন বেশি,যেসব দর্শন তিনি তাঁর পুরো জীবনে, এমনকি খেলার মধ্যেও জীবন্ত রেখেছেন এবং এতোই বেশি যে একটা সময় এসে আপনার মনে হতে পারে আপনি একটা সেলফ হেল্প আত্মোন্নয়নমূলক বেস্ট সেলার পড়ছেন। 

 

তবে গেইলের নিজেকে নিয়ে অতিরঞ্জিত গর্ব করার বিষয়টা আক্ষরিক অর্থেও অতিরঞ্জন মনে হতে পারে আপনার কাছে শেষদিকে। কেউ যদি তাঁর জীবনের গল্পগুলোকে লিখে একটা আত্মজীবনী বলে চালিয়ে দেয়, তবে সেখানে আরো বেশিই ক্রিকেটীয় উচ্ছ্বাস , ক্রিকেটীয় গর্ব থাকতে পারে, বইয়ের ঘটনা প্রবাহেও ধারাবাহিকতা থাকে, কিংবা প্লটে আরো দারুণ বিবরণী থাকে, কিন্তু তিনি যে গেইল, ক্রিকেট ঈশ্বর যাকে দুহাত ভরে দিয়েছেন, যার কাছে সব বাঁধাই যেন উচ্ছ্বাস, যেন সানকি বাজানো উচ্ছলতার কোলাহল। আর তাছাড়া সেরকম প্রথাগত কিছু হলে গেইলের বিরাট হৃদয় আর বিচিত্র জীবনাখ্যানের অনেকটাই যে মিস হয়ে যেতো, অমীমাংসিত থেকে যেতো। 

 

তাই আবারও একবার মনে করিয়ে দেই,বইটির সবকিছুই আপনাকে দেবে ভিন্ন এক স্বাদ। যে স্বাদ আহরণে আপনি অবগাহন করতে পারেন নীললোহিতের অন্তরালে, ডুব দিতে পারেন ক্রিকেট ঈশ্বরের আশীর্বাদের বরপুত্র ক্রিস্টফার হেনরি গেইলের আত্মজীবনীমূলক বই “সিক্স মেশিন” এর জীবনজলধিতে কল্লোলের ছন্দের সাথে নিজের অনুভুতিগুলোকে ভাসিয়ে দিয়ে অবলীলায়।

বাংলাকোষে লিখুন, আয় করুন... [email protected] 
বিঃদ্রঃ বাংলাকোষ কোনো সংবাদপত্র নয়, এটি মূলত একটি আর্কাইভ। বাংলাকোষ এ প্রকাশিত সকল তথ্য কপিরাইট এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোনো পূর্বানুমতি ছাড়া বাংলাকোষের কোনো তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। তবে অব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রসহ ব্যবহার করতে পারবে।