ইশরাত জাহান আনিকা
কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের এই পৃথিবীর শেষ কোথায়? বা আসলেই পৃথিবীর
কোনো শেষ আছে কিনা?
একজন মানুষের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত যেতে কতক্ষন সময় লাগতে পারে?
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন পুরো পৃথিবী পাড়ি দিতে একজন মানুষের সারা জীবন কেটে যাবে।
আসলে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সেরকম না।
অদ্ভুত সত্য হচ্ছে পৃথিবীর কোনো শেষ প্রান্ত নেই।
বরং অসীম এই মহাবিশ্বের প্রতিটি জায়গা দখল করে রাখছে তারকারাজির দল। এর ব্যাখ্যা দুইভাবে দেওয়া যেতে পারে
প্রথমত, আমরা মহাবিশ্বের যতটুকু অংশ দেখতে পাই তা সমতল ও অভিন্ন।অভিন্ন মানে হলো নক্ষত্রপুঞ্জ বা তারকারাজিরা একই মাত্রায় সংকুচিত বা প্রসারিত হচ্ছে। জ্যামিতিকভাবে এটা বলা যায় যে, এই সমান্তরাল মহাবিশ্ব আসলে বাকানো বা মোড়ানো না। সুতরাং এর এক প্রান্ত আরেক প্রান্তকে যুক্ত করছে যা আমাদের দৃষ্টিসীমার ভিতরে বা সসীম। এর আরেকটি কারণ হচ্ছে মহাবিশ্ব অনেকগুলো জিনিসের ভরের সমষ্টি। চাঁদ, তারকারাজি,গ্রহপুঞ্জ সবকিছুর সামষ্টিক ভরই হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব।সবার ভর যদি কয়েকবার মাপা হয় প্রতিবার একই ভর পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু আমরা বলছি পৃথিবী সমতল ও অভিন্ন, কাজেই এর প্রতিটি প্রান্ত একইরকম। অর্থাৎ প্রতিটি অংশ একই রকম সমতল। এইভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর আসলে কোনো শেষ প্রান্ত নেই। আমরা যেখানেই যাবো একই জায়গায় আবার ফিরে আসবো। যা আমাদের মেনে নিতে হয়তো একটু অদ্ভুত লাগতে পারে।
কোনো একটা মহাকাশযানে চড়ে যদি মহাবিশ্বের দিকে সোজা যাত্রা কর, তাহলে কোনোদিনও এর শেষ দেয়াল বা বাউন্ডারি খুজে পাওয়া যাবে না।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যদি এই বিশাল পৃথিবী বিগ ব্যাং থেকে সৃষ্টি হয়, তাহলে এর কোনো শেষ প্রান্ত কেন থাকবেনা? যদি একটি সসীম বিন্দু অবস্থা থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়, তাহলে এর শেষটাও তো সসীম হওয়ার কথা ছিল।
আসলে বিষয়টা হচ্ছে, বিগ ব্যাং কিন্তু শুধুমাত্র পৃথিবীর একটি অংশে হয়নি। বরং সব জায়গায় একসাথে ঘটেছে। এবং বিগ ব্যাং এর পর পৃথিবীর সবজায়গায় এর বেতার তরঙ্গের রশ্নি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেগুলো ক্রমাগত নিজেরাই বিকিরণ করছে। আসলে তারা নিজেরাই প্রসারিত হচ্ছে ক্রমাগত।
আমরা যদি মহাবিশ্বের বাইরে একটি সরলরেখা ধরে ক্রমাগত সোজা হাটতে থাকি তাহলেও কিন্তু আমাদের কখনোই শেষ প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব না।
বরং আমরা যে জায়গা থেকে হাটা শুরু করেছিলাম সে জায়গাতেই আবার ফিরে আসবো।
একটি উদাহরণ দিয়ে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি।ধরা যাক ছোট একটি পিপঁড়াকে একটি ফুটবলের উপর হাটতে দেয়া হলো এবং বলা হলো ফুটবলটির শেষ সীমানা খুজে বের করতে। পিপঁড়াটি কিন্তু কোনোভাবেই ফুটবলের শেষ সীমানা খুঁজে বের করতে পারবেনা। কারণ গোলাকার জিনিসের কোনো শেষ সীমানা থাকেনা।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও নোবেলবিজয়ী স্টিভেন ওয়েনবার্গের ভাষায়, সৌরজগত বা তারকাগুলো প্রসারিত হচ্ছে না। মহাবিশ্ব নিজেও প্রসারিত হচ্ছে না। বরং তারকাগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব আসলে একই সাথে সসীম ও অসীম। যা মেনে নেওয়া আমদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।
জীববিজ্ঞানী জেবিএস হাল্ডেন একবার মজা করে বলেছিলেন, মহাবিশ্ব নিয়ে আসলে আমরা যতোটুকু ভাবি, মহাবিশ্ব তার থেকেও বেশি অস্বাভাবিক। আমরা যতোটুকু কল্পনা করি, তার থেকেও অনেক বেশি জটিল।
মহাবিশ্বের বক্রতা নিয়ে আমরা একটি উদাহরণ দেখতে পারি। ধরা যাক একটি লোক সমতল কোনো জায়গায় বাস করে। এখন আমরা যদি তাকে আমাদের পৃথিবীর উপর নিয়ে এসে তাকে সোজা হেটে শেষ প্রান্তে যেতে বলি তাহলে কিন্তু সে কোনোদিনও শেষ প্রান্তে পৌছাতে পারবে না। বরং হেটে আবার আগের জায়গাতেই ফেরত আসবে। লোকটা এক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে। নীতিবাক্য
আমরা হচ্ছি আরও উঁচুমাত্রার মহাবিশ্বের সেই সমতল ভূমির দ্বিধাগ্রস্ত লোকটির মতো। আমাদের জন্য পৃথিবীর কোনো শেষ প্রান্ত নেই। অর্থাৎ আমরা কখনোই বলতে পারবো না পৃথিবী কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ঠিক একই ভাবে এটাও বলতে পারবো না যে পৃথিবীর শুরু বা কেন্দ্র কোথায়। আমাদের জন্য মহাবিশ্ব ততোদূর লম্বা যতোদূর পর্যন্ত আলো এই মহাবিশ্বকে দৃশ্যমান করে রেখেছে। আলো তার সর্বোচ্চ গতি দিয়ে যতোটুটু পৌঁছাতে পারছে আমরা শুধু ততোটুকুই দেখতে পাচ্ছি। সেই হিসেবে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এই পৃথিবীর শেষ সীমা আছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে যা আমরা দেখতে পাই না, অর্থাৎ পুরো বিশ্বের কোনো শেষ প্রান্ত নেই। এই বিশ্ব লক্ষ লক্ষ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত যেটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি।কিন্তু তারপরের অংশে কি আছে তা হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যাবে।