রহস্যের মোনালিসা, প্রতিদ্বন্দ্বী পার্ল এয়ার রিং, চিত্রকর্মগুলোর নেপথ্যে

নিয়াজ মাহমুদ সাকিব: তৎকালীন ৩০০,০০০,০০০ ইউরো সমমূল্যের একটি তৈলচিত্র,বাংলাদেশি মূল্যমান বিবেচনায় যার আসল দাম দাঁড়ায় ২৮,৪৬৩,৮০৩,৫৩৬ টাকা। “দ্যা গার্ল উইথ দ্যা পার্ল এয়ার রিং” খ্যাত জোহানেস ভারমিরের আঁকা এই তৈলচিত্রই এক সময় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি  ‘মোনালিসা’র সকল রেকর্ড ভেঙ্গে সবদিক থেকে ছাড়িয়ে যাবার চোখ রাঙ্গাচ্ছিলো!  উল্লেখ্য, মুদ্রামান তথা আর্থিক মূল্যমান মানদন্ডের হিসেব অনুযায়ী  ২০১৮ তে  মোনালিসার নিপাট দাম ৭০,১২১,৭২০,০০০ টাকা মাত্র।ওদিকে মূল্য হিসেব করলে ভারমিরের ৬৪,৫৫৬,৯১২,৩১৩ টাকা মূল্যমানের কালজয়ী সৃষ্টি “মুক্তো কানের দুলে বালিকা” র অবস্থান ছিল ঠিক মোনালিসার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে।

বর্তমানে  নেদারল্যান্ডের হেগের মওরিটসহুইটস এর একটি জাদুঘরে রাখা আছে ভারমিরের আঁকা বিশেষ এই  চিত্রকর্মটি। শিল্পের মূল্য কি আর অর্থ-কড়ি দিয়ে চুকানো যায়? তবে ভারমিরের এই চিত্রকর্মের সম্মানসূচক মূল্যও এতটাই নাগালের বাইরে যে, অনেক ধনকুবেরকেও  এই মূল্য চুকিয়ে শৈল্পিক এই চিত্রকর্মটি নিজের করে নিতে বেশ গলদঘর্ম হতে হবে সে ব্যাপারে খুব একটা সন্দেহ নেই বৈকি! এর গুরুত্ব বুঝতে সবথেকে প্রাসঙ্গিক যে তথ্যটি জানা জরুরি, তা হলো, নাৎসি আমলে এই ‘মুক্তো কানের দুলে বালিকা’র  মেকি, জালিয়াতি করা একটি তৈলচিত্র ও ২০০৪ সালের ৮ ই জুলাই ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিলামে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো!

নাৎসি বাহিনীর মাৎস্যন্যায়ের সময়ে ভারমিরের অনেকগুলো তৈলচিত্র জালিয়াতি হয়ে গিয়েছিলো। এবং এরই সাথে সাথে নাৎসি বাহিনীর শিল্প সম্বন্ধীয় প্রোপাগান্ডাও বেশ সফল হয়েছিলো! ডাচ মোনালিসা ছাড়াও ভারমিরের অন্যান্য চিত্রকর্মগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে ঠিক কতখানি, তা এই জালিয়াতির ঘটনাগুলো থেকেই যথাযথ উপলব্ধি করা যায়।

তবে নেদারল্যান্ড কর্তৃপক্ষের জন্য স্বস্তির ব্যাপার এটাই যে,আসল চিত্র কর্মটি এখনো পর্যন্ত কোনো অসাধুর হাতে পড়েনি! আর পৃথিবীর সবথেকে রহস্যময়ী হাসির অধিকারিণী,ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্যমন্ডিত ভিঞ্চির মোনালিসার থেকে শৈল্পিকতা, ভাবের প্রগাঢ়তা তথা কোনো দিক দিয়েই হয়তো কম যায়না বলেই এই চিত্রকর্মের অন্য নাম দেয়া হয়েছিলো ডাচ মোনালিসা!

বিশেষ এই চিত্রকর্ম নিয়ে চুল-চেড়া বিশ্লেষণ হওয়াটাই স্বাভাবিক! আর এই বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ছবিটাকে ঘিরে তৈরি হয় নতুন বিতর্কের।  চিত্রকর্মটি আসলে কি কোনো তৈলচিত্র নাকি কোনো ট্রনি?

এই রহস্যের দ্বার ঠিক তখনই উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিলো যখন নাম না জানা প্রাচীন এক পান্ডুলিপি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ট্রনি আর তৈলচিত্রের সংজ্ঞায়ন আর পার্থক্য! তারপরেও এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি এখনো! তবে সমসাময়িক সময়ের অধিকাংশ শিল্প সমালোচকেরাই দাবী করে থাকেন যে, “দ্যা গার্ল উইথ আ পার্ল এয়ার রিং” আদতে একটি তৈলচিত্র, তবুও বিশেষ এই চিত্রকর্ম নিয়ে রয়ে যাওয়া প্রচলিত যে ধারণা তা হলো, মূলত, এটি একটি ট্রোনি।কারন শুধুমাত্র একটি ট্রোনিই  জীবন্ত কোনো মডেলের মুখের অভিব্যক্তিসমূহ নিয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি ট্রনি কখনোই  বুদ্ধিবৃত্তীয়, সামাজিক বা নৈতিক জটিলতায় তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি।

 

ভার্মিরের সমসাময়িক আমলে প্রতিকৃতিগুলি তথা তৈলচিত্র কিংবা ট্রোনিতে উপস্থাপন করা চরিত্রগুলোকে ধরা হতো একেকটা সামাজিক অবস্থানের প্রতীক, এবং সেসব চিত্রকর্ম সৃষ্টির পেছনের পৃষ্ঠপোষকেরা ছিলেন এমন ব্যক্তিবর্গ  যাঁরা ওই প্রজন্মের সেরা মেধাবী কিংবা সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়েও অনেক উঁচুতে অবস্থানকারী। বাড়িয়ে বললে, তৎকালীন সমাজ, রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ হিসেবে যারা বিরাজমান ছিলেন এবং তাদের অনেকেই  শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিকে নানানভাবে উপস্থাপন করতে চাইতেন তাদের নিজেদের স্বার্থ তথা কর্তৃত্ব রক্ষার্থে।

 

কিন্তু ভারমিরের এই চিত্রকর্ম নিয়ে কেউ তেমন একটা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পাননি। না পেলে কি হবে, তাঁরা কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রথাবিরোধী চিত্রশিল্পীদের একজন মূর্ত মানব ভারমিরের নামের সাথে নারীবাদী ভন্ড তকমা জুড়ে দিতে ভুল করেন নি!

তৎকালীন সময়ে ধন, মর্যাদা বা ধর্মীয় যোগ্যতার মতো বিষয়গুলোকেই জনসাধারণের সামনে শৈল্পিক উপায়ে তুলে ধরতে এই তৈলচিত্র কিংবা ট্রোনিকে ত্রূপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতো খ্যাতিমান সব চিত্রশিল্পীরা।

‘মুক্তো কানের দুলে বালিকা’ তৈলচিত্রে, আপাত দৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া যায় এক উঠতি যুবতীকে,যে কিনা নিজের কাঁধ বরাবর পেছন দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকাতেই কিছু একটা দেখে চমকে উঠেছে।ঠিক কাকে দেখে কিংবা কি দেখে এই উঠতি যুবতী বালিকা চমকে উঠেছিলো তা এখনো অজানা রহস্যই রয়ে গেছে। আর এহেন রহস্যই  আমাদেরকে এই চিত্রকর্মের প্রতি এবং  চিত্রশিল্পী ভারমিরের দক্ষতার প্রতি  বিশেষভাবে নজর দিতে বাধ্য করে।

 

চিত্রকর্মের মডেল বালিকা তথা উঠতি যুবতী কিশোরীকে এমন চমকিত ভাবে উপস্থাপন করার পেছনে ভারমিরের যে নেহায়েতই কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা, এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

অধিকাংশ চিত্রকর্ম বিশ্লেষক,সমালোচক এবং শিল্পানুরাগীরা এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, ভারমিরের  চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল এমন একটি ট্রনি তৈরি করা, যে ট্রনি মুহূর্তের উত্তেজনায় মানুষের সামনে তাঁর একান্ত নিজস্ব উদ্দেশ্যপূর্ণ দর্শন এবং অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারবে এবং একই সাথে ছবিটা তথা চিত্রকর্মকে ( চিত্রকর্মের উপস্থাপনকে) ঘিরে থাকা রহস্যকে পুঁজি করেই যে যার মতো নিজেদের ভাবনার জগতে নিজেদের মতো করে নিজস্ব গল্প তৈরি করে নিতে পারবে। জীবন নিয়ে উক্তি

তাই যদি রহস্য উন্মোচনের নিমিত্তে যুগ যুগ ধরে প্রচেষ্টার বিষয়টাও বিবেচনা করা হয়, তাতেও কিন্তু “দ্যা গার্ল উইথ আ পার্ল এয়ার রিং” মোনালিসার থেকে খুব একটা পিছিয়ে আছে বলা যাবেনা।

আর এই তৈলচিত্র/ট্রনির মডেল  ডাচ মোনালিসাই যে চিত্রকর্মটির মূল শিল্পী ভারমিরের একান্ত প্রথম তনয়া মারিয়া সে বিষয়েও কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একমত!

“মুক্তো কানের দুলে বালিকা” বেশিরভাগ সময়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা কোনো এক সমতল অঞ্চলের এক উঠতি যুবতীর মনস্তত্ত্ব ই প্রস্ফুটিত করে তোলে।  অন্তরঙ্গ সুনিপুণ অবয়ব আর নান্দনিকতার প্রস্ফুটনে ভারমিরের জুড়ি নেই, আর এই “ দ্যা গার্ল উইথ আ পার্ল এয়ার রিং” কেই তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ তৈলচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই চিত্রকর্মের বিশেষত্বই  যুগ যুগ ধরে সকল জ্ঞানপিপাসু শিল্পানুরাগী মানুষের দৃষ্টি কেবল এই চিত্রকর্মের দিকেই বারবার  ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছে। তাই অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত অনুযায়ী,মোনালিসার সাথে “দ্য গার্ল উইথ আ পার্ল এয়ার রিং” কে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যায়ই বটে!

নৈপুণ্যের বিকাশে  জীবন উৎসর্গ  করা ভারমির সপ্তদশ শতকের সত্তরের দশকে সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ব আর অবদান সম্পর্কে একটু বেশিই সচেতন হয়ে পড়ছিলেন, যার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় এই কালজয়ী সৃষ্টি “ দ্যা গার্ল উইথ পার্ল এয়ার রিং” এর।

আন্ডার-পেইন্টিং আর মনোক্রোম্যাটিক গ্রাউন্ড তথা এক রঙ্গা ক্যানভাসের সমন্বয়ে ভারমির সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অমর কর্ম “মুক্তো কানের দুলে বালিকা”। প্যালেটের নন্দন তত্ত্বের সুনিপুণ কারিগর হয়েই তিনি যুবতীর হেড ড্রেস আর গাউন এর মাধ্যমে গভীরতাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এবং গভীরতাকে আরো প্রগাঢ় লাস্যময়ী আর রহস্যময়ী করে তুলেছিলেন বালিকার মুক্তোর দুল, মায়াবী হাসি আর ঐন্দ্রজালিকতাঁর ঘোরের চমকিত চাহুনির দ্বারা। আর এসব সুনিপুণতার বিশ্লেষণ করলে মোনালিসার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই ভারমিরের “মুক্তো কানের দুলে বালিকা” কে বিবেচনা করা ছাড়া কোনো ফুসরৎ নেই।

নাৎসি বাহিনীর মাৎস্যন্যায়ের সময়ে ভারমিরের অনেকগুলো তৈলচিত্র জালিয়াতি হয়ে গিয়েছিলো। এবং এরই সাথে সাথে নাৎসি বাহিনীর শিল্প সম্বন্ধীয় প্রোপাগান্ডাও বেশ সফল হয়েছিলো! ডাচ মোনালিসা ছাড়াও ভারমিরের অন্যান্য চিত্রকর্মগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে ঠিক কতখানি, তা এই জালিয়াতির ঘটনাগুলো থেকেই যথাযথ উপলব্ধি করা যায়।

বিশেষ এই চিত্রকর্মের সাথে সাথে ভারমিরের অন্যান্য চিত্রকর্মগুলোর  ঐতিহাসিক,সামাজিক,রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতিক গুরুত্ব ও বেমালুম তাৎপর্যপূর্ণ! যা জানতে আপনি অতি উৎসাহ সহকারেই পরবর্তী পর্বগুলো  ও বাংলা কোষের সাথেই থাকবেন।

বাংলাকোষে লিখুন, আয় করুন... [email protected] 
বিঃদ্রঃ বাংলাকোষ কোনো সংবাদপত্র নয়, এটি মূলত একটি আর্কাইভ। বাংলাকোষ এ প্রকাশিত সকল তথ্য কপিরাইট এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোনো পূর্বানুমতি ছাড়া বাংলাকোষের কোনো তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। তবে অব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রসহ ব্যবহার করতে পারবে।