নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ ডারিম্পল আসলে যে ইতিহাস লিখেছেন, তা যেন সঞ্জীবণী সুধার সঞ্চার করে, সজীবতায় ভরিয়ে তোলে ইতিহাসকে। আর ডারিম্পল নিজেও যেন তার জীবনটা ইতিহাস দিয়েই যাপন করে গেছেন। তবে বইটিতে ভালোভাবেই মুন্সীয়ানা দেখানো হয়েছে একটা জায়গায় গিয়ে, সেটা হচ্ছে “ ক্ষমতার বৈধতা”।
অতীতের সবকিছুকে বর্তমানের সাথে প্রাসঙ্গিক করে যেভাবে তুলে ধরেছেন ডারিম্পল, তার সার্থকতা ঠিক এখানেই। শক্তি,অর্থ এবং দুর্নীতির মায়াজাল আজও যে পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে হাতের মুঠোয় নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে,তা জনসাধারণের জন্য উন্মোচিত করে দেওয়া ,এতেই তো আসল সার্থকতা নিহিত রয়েছে বৈকি!!!
লুট শব্দটার উৎপত্তি কিভাবে? কোথা থেকে কি করে এলো এই ‘লুট’ শব্দটি! লুট শব্দটি মূলত ‘লুন্ঠন’ শব্দেরই দৈনন্দিন ব্যবহৃত স্ল্যাং সমার্থক। এই শব্দের অর্থগত আর উৎপত্তিগত উৎসের কথা আলোকপাত করেই সূচনা হয় বইটির। ইংরেজী ভাষায় শব্দটার আদতে আমদানি হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর তাঁদের অধিকারিকদের দ্বারা বাংলা, মহীশূর, ডেকান, হায়দারাবাদ এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লীসহ বিস্তৃত ভারতীয় উপমহাদেশে চলা দীর্ঘ ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা লুন্ঠন এর প্রভাবের ফলস্বরূপ! দ্যা আনারকিঃ দ্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাইস অফ কর্পোরেট গ্রিড, এবং লুন্ঠিত এক সাম্রাজ্য ( দ্যা পিলেজ অফ অ্যান এম্পায়ার ২০১৯) বইতে তার নিজস্ব বিস্তৃত গবেষণা, ভ্রমণ, শ এ শ এ মানুষের সাক্ষাৎকার আর সরল গদ্যশৈলী দিয়ে এসবকিছুই ফুটিয়ে তুলেছেন!
ডারিম্পল আসলে দ্যা আনারকিঃ দ্যা রিলেন্টলেস রাইজ অফ দ্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বইতে যে ইতিহাস লিখেছেন, তা যেন সঞ্জীবণী সুধার সঞ্চার করে, সজীবতায় ভরিয়ে তোলে ইতিহাসকে।যে ইতিহাস জয়ের, অরাজকতার, আর রেখে যাওয়া ক্ষতের আবার একই সাথে সেই ক্ষতকে উদযাপন করে বিজয়গাঁথা রচনার। আর ডারিম্পল নিজেও যেন তার জীবনটা ইতিহাস দিয়েই যাপন করে গেছেন। তবে বইটিতে ভালোভাবেই মুন্সীয়ানা দেখানো হয়েছে একটা জায়গায় গিয়ে, সেটা হচ্ছে “ ক্ষমতার বৈধতা”। খুব বেশি ভাবগাম্ভীর্য না রেখে যেন নদীর স্রোতের মতো ডারিম্পল বলে গেছেন কি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারত বর্ষকে লুট করে খালি করে রেখে গেছে।
ইংরেজী ১৭৬০ এর দিকে যখন শাহ আলম দিল্লীর মসনদে বসেছিলেন, তখন পুরো ভারত জুড়েই বেশ কয়েকটি সামরিক শক্তি ছিল আর প্রত্যেকটা শক্তিই ছিল আধিপত্যবাদী এবং আঞ্চলিক। ইরানের নাদির শাহ তো ততোদিনে দিল্লীকে বিধ্বস্ত করে মিশিয়ে দিয়ে গেছে, আর সাথে করে নিয়ে গেছে কোহিনুর, নিজের পুরস্কার মনে করে আর রেখে যান রাজনৈতিক , অর্থনৈতিকভাবে ধ্বজভঙ্গ আর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এক সাম্রাজ্য! যে সাম্রাজ্যের মুঘল সম্রাটও মুষড়ে পড়েছিলেন এই এক ধাক্কায়! কিন্তু এই শত কিছু হয়ে গেলেও তিনি যে তার জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন, সেই শেষ পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি তার জনগণের শাসক হয়েই আসীন ছিলেন জনগণের হৃদয়ে।
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ এই কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে, অর্থাৎ পূর্ব-বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশে সরাসরি কর আদায়ের অধিকার অর্জন করলেও, এই অঞ্চলগুলোর কল্যাণ ছিল তাঁদের (কোম্পানির) কাছে দায়সারা গোছের মতো! আর এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক ও নয় বৈকি!
বিস্তৃত এক একটা অঞ্চল মুঘলরা শাসন করতো।যে মুঘল পরাশক্তি দু শতাব্দী পূর্বে দিল্লীসহ পুরো উত্তর ভারতকে করতলগত করেছিলো। যে সময়টাতে হকিন্সরা এসেছিলো, সেসময় এই সাম্রাজ্যে অন্তত পক্ষে ৪০ লক্ষ পুরুষ অস্ত্রের মতো ছিল।যাদেরকে যেকোনো সময় কাজে লাগানো যেতে পারে। আর যখন পর্তুগিজ বণিকেরা বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে অনুমতি ছাড়াই একের পর এক দুর্গ নির্মাণ শুরু করলো একদম ঠিক গঙ্গার বিস্তীর্ণ অববাহিকা জুড়ে, সম্রাট তখন এক প্রকার চাপা কষ্ট আর বিব্রতকর স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই ইউরোপীয়দের আনাগোনা উন্মুক্ত করে দিলেন। বিশেষ করে ছাড় দিলেন বাণিজ্য তথা সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে। মুঘল রাজধানীগুলো ব্যবসায়ী, শিল্পী, কবি, অভিজাত, যোদ্ধা এবং আলেমদের নিয়েই ত্রস্তব্যাস্ত ছিল, আর এদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে রাজস্ব ভান্ডারে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সমতুল্য মুদ্রাপ্রবাহে ভূমিকা রেখেছিল।
ভারতবর্ষ আসলে শিল্প বিস্ফোরণের এক উপযুক্ত শক্তিভান্ডার ছিল। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে। ফলতই আলাদা নজর! উইলিয়াম ডারিম্পল তার দুর্দান্ত এই বইয়ের প্রথমদিকে যেমন উল্লেখ করেছেন, ইংরেজি শব্দ পাজামা, চিন্টজ, ক্যালিকো, তফিতা, শাল এবং ডুঙ্গারিগুলি সমস্তই ভারতীয় বংশোদ্ভূত।ঠিক তেমনি ভাবে লুট শব্দটাও। কারন পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে এই লুট শব্দটাই নিয়েছিলো, যার প্রায়োগিক প্রতিফলন ও তারা কাজে দেখিয়ে দিয়েছে। উপমহাদেশীয় এ উপকূলে হকিন্স আগমনের ২০০ বছরের মধ্যে, মুঘল সম্রাট তথা সাম্রাজ্য ব্রিটিশ রাণীর নয় বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনে অবস্থিত একটি বেসরকারী মুনাফার কর্পোরেশনের কার্যকর কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিলো আর বছরের পর বছর ধরে শুধুই কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো! দক্ষতা, ভারসাম্য, সংবেদনশীলতা কঠোরতা আর কুটিলতার সাথেই বছরের পর বছর ধরে নিষ্পেষিত করে ভারতবর্ষকে কিভাবে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছিল তারই একটা স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলো ডারিম্পল এই বইটিতে।
হিংস্রতা! কুটিলতা! যুদ্ধ! লুণ্ঠন! গণহত্যা যে বইটির প্রতি পরতে পরতে জায়গা করে নিয়েছিলো!
সে যাই হোক, কোম্পানির কর্মকর্তারা তাঁদের ক্ষমতার যাচ্ছেতাই ব্যবহার শুরু করলে ঠিক হাতে হাতে পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশীয় এ অঞ্চলে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এসে ভয়াল থাবা দিয়ে যায়, যার করাল গ্রাসের শিকার দশ মিলিয়ন মানুষের জীবন।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি নাগাদ, অটোমান সামরিক বাহিনী হাবসবার্গ এবং রাশিয়ার পেছনে পড়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং অন্যান্য উঠতি ইউরোপীয় শক্তি, এশিয়া ,আফ্রিকা এবং আমেরিকায় বাণিজ্য কুঠি এবং উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগীতায় একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায় আর এ প্রতিযোগীতায় শামিল হয় ধণিক শ্রেণীও অথচ ওই দিকে কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য আস্তে আস্তে নীরবে পতনের দোরগোড়ায় এসে উপনীত হতে থাকে। অথচ তারা এক সময় প্রাণচঞ্চলতা এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিল,এবং সবসময় দু: সাহসিক কাজ এবং বহুমুখী অনুসন্ধানের জন্য মুখিয়ে থাকতো। ডারিম্পল যে গল্প বলে, সে গল্প শুধুই আপনাকে আঁটকে রাখবে গ্লুর মতো, একের পর এক অতীতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা পাতায় পাতায় আপনার সামনে উঠে আসবে আর আপনি ঠিক সেই মাঠের যুদ্ধ, বাণিজ্য কুঠীর ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যের পতন, সাম্রাজ্যের দখল, অর্থনীতির বেহাল দশা, লুন্ঠন আর ফিরে আসার গল্প, উঠে দাঁড়ানোর সব গল্প, সব যেন অনুভব করতে পারবেন আর এতোটাই নিমগ্ন হয়ে যাবেন যে বইয়ের কলেবর আর আপনি টেরই পাবেন না!
তিনি তার আগের আরো তিন ডারিম্পল,স্টেয়ার, জেমস এবং আলেকজান্ডারকেও বর্ণনায় তুলে এনেছেন যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এসব ঐতিহাসিক ঘটনা পটের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিল কিংবা ছিল প্রত্যক্ষ সাক্ষ্মী যা অন্যান্য ছোট ছোট কিন্তু উল্লেখযোগ্য সব ঘটনা বর্ণনায় দুর্দান্ত মেলবন্ধনের জন্ম দিয়েছিলো। যখন মীরজাফর ও তার ছেলে মিরান দুজনেই সিরাজের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী লুৎফুন নিসাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো,তখন লুতফুন্নেসা উত্তর দিয়েছিলেন: “হাতিতে চড়া মানুষ আমি অবশ্যই ঘোড়া গাধার পিঠে চড়তে রাজি হতে পারি না।”
কর্পোরেট লালসার জঞ্জাল কিন্তু আবার মোটেও ফেলনা বিষয় নয়। বরঞ্চ ডারিম্পল এই বিষয়েই গুরুত্ব দিয়েছেন সব থেকে বেশি। ইংরেজী ১৭৭৩ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ কৌশল এবং অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো। তবে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে নিয়েছিলো রাজপরিবার। এটির প্রায় ১.৪ মিলিয়ন পাউন্ড – যা আজ ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের সমপরিমাণ ঋণ মওকুফ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো রাজপরিবার – কারণ সংসদ সদস্যদের প্রায় এক চতুর্থাংশ সদস্যই এই কোম্পানির অংশীদার ছিলেন। ওই সময়ে এর পেছনে তাঁদের যে যুক্তি ছিল, তা এখনো প্রাসঙ্গিক! অবশ্য ইদানীং শোনাও যায় বটে! টু বিগ টু ফেইল!!
লন্ডনে অবস্থিত কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত মাত্র ৩৫ জন কর্মচারী নিয়ে তারা পুরো ভারত বর্ষ জয় করে নিয়েছিলো , দুশো বছর ধরে চালিয়েছে, সাথে নির্মম দক্ষতার সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড পাচার করেছে, এমন কোম্পানি কি করে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারতো! কল্পনাতেও সম্ভব ছিলনা হয়তো! ডারিম্পল যুক্তি দেখান যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে এই কর্পোরেট সংস্কৃতি আজও প্রচলিত রয়েছে যেমনটি ইরাক এবং অন্য কোথাও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়, করদাতাদের অর্থের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করা হয়েছিলো মাত্র গুটিকয়েক লোকের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য! কি অদ্ভুত নিষ্ঠুর! লাঠিপেটা চলতে থাকে, সঙ্গে লুণ্ঠন ও অবিরাম!অত্যাচারী এই কোম্পানি বাংলায় তাদের দেওয়ানি অধিকার রক্ষায় পুরো ব্রিটিশ সংসদই প্রায় কিনে রেখেছিলো। বর্তমান সময়ের আধুনিক কর্পোরেশনগুলি একইভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছে, নীরবে নিভৃতে স্বার্থ চরিতার্থ করে যাচ্ছে দুর্বল প্রশাসন আর আইনী ফাঁক ফোকড় এর সুযোগ নিয়ে। অতীতের সবকিছুকে বর্তমানের সাথে প্রাসঙ্গিক করে যেভাবে তুলে ধরেছেন ডারিম্পল, তার সার্থকতা ঠিক এখানেই। শক্তি,অর্থ এবং দুর্নীতির মায়াজাল আজও যে পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে হাতের মুঠোয় নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে,তা জনসাধারণের জন্য উন্মোচিত করে দেওয়া ,এতেই তো আসল সার্থকতা নিহিত রয়েছে বৈকি!!! তাই ইতিহাসের পরতে পরতে হারিয়ে যাওয়া মিস না করতে চাইলে “দ্যা অ্যানারকি” এক অবশ্য সুখপাঠ্য!!